''অনেক সুখ স্মৃতি, আর দেখা হবে না, এই বোধটা ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে'', লিখলেন ঊর্মিমালা বসু
কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে প্রথম দেখাতেই কেমন আত্মীয়তা তৈরি হয়ে যায়, গৌরীদির গুণেই সেটা তৈরি হয়েছিল।
ঊর্মিমালা বসু : আমাদের সঙ্গে সম্পর্কটা কাজের মধ্যে দিয়ে শুরু হলেও আমার সঙ্গে গৌরীদি, পার্থদার সম্পর্কটা কোনও কেজো সম্পর্ক ছিল না। আমি ওঁকে প্রথম দেখেছিলাম আকাশবাণী ভবনে, আমার আর জগন্নাথের বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে গিয়েছিলাম। খুব মনে পড়ছে, ডিউটি রুমের সামনে গৌরীদি দাঁড়িয়ে, আমি প্রণাম করে বললাম, আমাদের বাড়িতে আসবেন। তার আগে অবশ্য ওঁকে মঞ্চে দেখেছি। আমি যখন গ্র্যাজুয়েশন করছি, তখন থেকেই পার্থ ঘোষ-গৌরী ঘোষ নামের সঙ্গে পরিচিতি। তবে স্বশরীরে বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে আকাশবাণীতে প্রথম দেখি। কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে প্রথম দেখাতেই কেমন আত্মীয়তা তৈরি হয়ে যায়, গৌরীদির গুণেই সেটা তৈরি হয়েছিল। ''ওমা তুই! আয় আয়, দেখি'', এভাবেই আদর করে ডাকতেন।
আমি শুরুতে কাজ করিনি, বিয়ের ১২ বছর পরে এই পেশায় আসি। তবে ওঁদের সঙ্গী ছিলাম সবসময়, কারণ জগন্নাথের (জগন্নাথ বসু) সঙ্গেই সব সময় যেতাম। সেকারণেই আমরা একটা পরিবার হয়ে গিয়েছিলাম। যখন কাজ করতে গেছি, তখন প্রথম কথাটাই গৌরীদির সম্পর্কে আমার মনে হয়েছে সেটা হল উচ্চারণ। বাংলা ভাষার এমন স্পষ্ট উচ্চারণ ভীষণই দুর্লভ। আর সেই উচ্চারণটা ছিল Effortless, সহজ, স্বাভাবিক। আমি একটা ভালোভাবে করছি বলে কিছু করা, আর অবলীলাক্রমে কিছু করার মধ্যে অনেক তফাৎ। উনি অবলীলায় সেটা করতেন। আমি একবার বলেছিলাম এটা আমাদের 'কৃত্য'। এই শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম বলে গৌরীদি আমায় বলেছিলেন, ''তুই কী সুন্দর করে বললি''। আর গৌরীদি যখন বলছেন, তখন আরও ভালো করে বাংলা বলার ঝোঁক বেড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের ১২৫ তম জন্মদিন উপলক্ষ্যে দুরদর্শনে শ্রুতি নাটক 'রবীন্দ্রনাথের রবিবার' হয়েছিল, সেখানেই আমার প্রথম আত্মপ্রকাশ। খুব মনে পড়ে, সেদিন গৌরীদি আর পার্থদা রাত ১১টার সময় আমাদের বাড়ির সামনে হর্ন বাজাচ্ছিলেন, অত রাতে হর্ন বাজছে শুনে আমরা সবাই উৎকর্ণ হয়ে বারান্দায় চলে এলাম। দৌড়ে যেতেই গৌরীদি বললেন, ''তোরা কী ভালো করলি, কী ভালো করলি''। এই যে সহকর্মীকে একটা Compliment দেওয়া, যে সবে শুরু করেছে, এটাও তো একটা শিক্ষার। আজকাল যখন আমরা অনুষ্ঠান করি, তখন ব্যকস্টেজে সবাই গল্প করে, পরে বের হলে বলেন, কী ভালো করলে, অথবা বলেই না, যেন শোনেই নি এমন একটা ভাব করে।
গৌরীদির কাছে অনেক স্নেহ পেয়েছি। ইদানিং মঞ্চে আসতেন না, কিন্তু নেপথ্যে থেকে প্রযোজনা করতেন, শিল্পের সঙ্গে জুড়ে থাকা। রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা, চিরকুমার সভা, লোপামিত্রা, শ্রীকান্ত আচার্যদের নিয়ে করেছেন, তাতে আমরাও থেকেছি। শিল্পের সঙ্গে এই যে জড়িয়ে থাকা, এটাও গৌরীদির কাছে শেখা। মজার ঘটনা তো অনেক আছে, গৌরীদি-পার্থদার ঝগড়া শুনে নীরেনদা (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী) বলেছিলেন, ''ওদের ঝগড়া করাটা শোনো দেখবে গৌরীর কখনও উচ্চারণ খারাপ হয় না।'' আমার চোখে দেখা আরও একটা ঘটনা, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে শিশির মঞ্চে অনুষ্ঠান হচ্ছে। শক্তিদা দর্শক আসন থেকে গমগমে গলায় বললেন, ''গৌরী, একটি পরমাদ ছিল'', একজন আবৃত্তিকার আর কী চাইতে পারেন, যেখান কবি তাঁর কাছ থেকে কবিতা শুনতে চাইছেন। মানুষের অনেককিছু পাওয়ার মধ্যে এটা একটা পরম পাওয়া।
আমরা একসঙ্গে চাঁদীপুর, দীঘা বেড়াতে যেতাম, একবার চাঁদ ওঠেনি। ঘুটঘুটে অন্ধকার, হঠাৎ দেখি চাঁদ উঠল, তখন সে আলোর মধ্যে গৌরীদি গান ধরলেন ''যখন এসেছিলে অন্ধকারে, চাঁদ ওঠে নি'', কী যে ভালো গান করতেন...। খুব উচ্চকিত গলা ছিল তা নয়, কিন্তু রিনরিনে সেই গলা...। আর গৌরীদির সেই চোখ, কাজল পরা বোধহয় ওমন চোখেই মানায়। আমার এটা সবসময় মনে হত, বললেই বলতেন ''তুই চুপ কর তো''। ভীষণ মজার ছিলেন। আমার খুব চুল ছিল, একবার চাঁদীপুরে জগন্নাথের পাজামা-পাঞ্জাবি পরে স্নান করে ফিরছি। একজন সাহেব এসে ছবি তুলতে চাইলেন। গৌরীদি মজা করে বললেন, ''তোর ওই চুল বুঝলি''। আসলে মানুষকে ভালোবাসলে এভাবেই হয়ত superlative-এ নিয়ে যাওয়া যায়। গৌরীদির কিছু বললে আমার মধ্যে একটা প্রত্যয় জন্মাত। পার্থদা কানে একটু কম শুনতেন বলে আমি বলতাম মেশিন লাগাও। পার্থদা তখন বলতেন, ''তুই চুপ কর, গৌরী চোখে কম দেখে ও যদি পড়ে যায়, লোকে বলবে আহা, আর আমি এটা পরলে বলবে কালা''। দুঃখের সময়ও সেই মজার কথাগুলোই মনে পড়ে। ওঁর কোনও অভিযোগ ছিল না, কখনও বলতেন না, তুই দেখতে আসিস না। বলতেন, সময় পেলে আসিস। এরকমই অজস্র স্মৃতি। জগন্নাথকে 'শেষের কবিতা'র সময় ধুতি পরিয়ে দিয়েছিলেন, জগন্নাথ ধুতি পরতে পারত না, ''উনি বললেন থাক তুই এদিকে আয়।'' আবার সেই ধুতি পরানোটা সম্পূর্ণ করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অনেক সুখ স্মৃতি। আমার ওনাকে নিজের দিদির থেকেও বেশি মনে হয়। অসময়ে গৌরীদি চলে গেলেন। এই যে আর দেখা হবে না, এই বোধটা ভীষণই কষ্ট দেয়।