ভারতীয় সিনেমার মুকুটহীন সম্রাট দেবকীকুমার বসু!
বর্ধমানে তোয়ালে বেচতেন। হয়ে গেলেন ভারতীয় সিনেমার পথিকৃৎ
সৌমিত্র সেন
প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর ব্যাপার থাকে। ভারতীয় চলচ্চিত্রে সেই সলতে পাকিয়েছিলেন দেবকীকুমার বসু।
১৮৯৮ সালের ২৫ নভেম্বরে বর্ধমানে জন্ম দেবকীকুমার বসুর। গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে পড়া ছেড়ে দিলেন। শুরু করলেন পত্রিকা সম্পাদনার কাজ। পাশাপাশি তোয়ালেও বেচতেন। কিন্তু প্রতিভার এমনই গতিধারা, পড়া-ছেড়ে-দেওয়া তোয়ালে-বেচা তরুণ কালক্রমে হয়ে দাঁড়ালেন ভারতীয় সিনেমার পথিকৃৎ, প্রাণপুরুষ।
বাংলা এবং হিন্দি দুই ভাষাতেই ছবি পরিচালনা করেছেন। পরিচালক জীবন শুরু করেন ধীরেন গাঙ্গুলির সঙ্গে। পরে কাজ করেন প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে। পরিশেষ তিনি নিউ থিয়েটার্সে যুক্ত হন। তবে নিজের প্রোডাকশন হাউস খোলেন আরও পরে, ১৯৪৫ সালে।
তাঁর অধিকাংশ ছবিই একালের দর্শকদের না দেখা। তবে কয়েকটি ছবি অবশ্য একালের মানুষও একবাক্যে চেনেন। 'নবজন্ম' (১৯৫৬), 'ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য' (১৯৫৪), 'চিরকুমার সভা' (১৯৫৬) বাংলাছবির রত্ন। তাঁর চণ্ডীদাস (১৯৩২), বিদ্যাপতি (১৯৩৭)-র সঙ্গেও আমরা কিঞ্চিৎ পরিচিত।
অনেক ফিল্ম-সমালোচকই তাঁর মধ্যে এক ধরনের বৈষ্ণবীয় মনোভাবনার ছাপ দেখতে পান। তাঁর 'চণ্ডীদাস', 'বিদ্যাপতি' ও 'ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য'ই এই বৈষ্ণবীয় ভাবনার ট্রিলজি। যে ছবিগুলির মধ্যে এক ধরনের শান্তরস দর্শককে আপ্লুত করে।
'চণ্ডীদাস' দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। দুর্গাদাস ও উমাশশী অভিনীত এই ছবির সংলাপ, গান, নেপথ্যসঙ্গীত আলোড়িত করেছিল বাঙালিচিত্তকে। 'ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য' বাঙালিকে যেন নতুন করে ভক্তি আন্দোলনের আবহাওয়ায় ডুবিয়ে দিয়েছিল।
ভারতীয় সিনেমাতে অনেক বিষয়েই তাঁর পথিকৃৎসম অবদান রয়েছে। তবে তার মধ্যেও আলাদা করে বলতে হয় ছবিতে ধ্বনি সঙ্গীত ও আবহ নিয়ে তাঁর অবদানের কথা। ভারতীয় ছবিতে তিনিই প্রথম ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের ব্যবহার করেন। 'চণ্ডীদাস'ছবিতে। তিনিই প্রথম ভারতীয় পরিচালক যিনি আন্তর্জাতিক সম্মান এনেছিলেন। তাঁর 'সীতা' (১৯৩৪) প্রথম ভারতীয় ছবি, যা সাগরপারে দেখানো হয়েছিল। কবিতা থেকে ছবি করারও পথিকৃৎ তিনি। প্রায় চলতি ভাবনাবলয়ের বাইরে গিয়ে রবীন্দ্রশতবর্ষে এই নিরীক্ষায় মাতলেন তিনি। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের চারটি কবিতার ওপর নির্ভর করে বানালেন 'অর্ঘ্য'।
নির্বাক ও সবাক ছবির সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে তাঁর আধুনিক ভাবনার কাজের মাধ্যমে যে বিপুল অবদান তিনি ভারতীয় ছবিতে রেখে গিয়েছেন সম্ভবত আজও তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। ১৯৫৭ সালে 'সঙ্গীত নাটক একাডেমি' পেয়েছিলেন। পরের বছরই 'পদ্মশ্রী' সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৫৯ সালে প্রথম 'জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার' পেয়েছিল তাঁর পরিচালিত 'ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য' ছবিটি।
প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকানোর কাজ যে তিনিই করেছিলেন, তার একটা অন্যরকম সমর্থনও মেলে। শোনা যায়, 'পথের পাঁচালী' নিয়ে ছবি করার কথা তিনিই প্রথম ভেবেছিলেন। তাঁর কাজ বেশ খানিকটা এগিয়েও গিয়েছিল। কিন্তু কোনওভাবে লোকমুখে তিনি শোনেন, সুকুমারপুত্র সত্যজিৎও এই কাহিনী নিয়ে ছবির কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। শোনা যায়, সত্যজিৎ তাঁর সঙ্গে দেখাও করেন বিষয়টি নিয়ে। তিনি সত্যজিৎকেই ছবিটি করার অনুমতি দেন। শুধু তাই নয়, মুক্তির পরে তিনি স্বয়ং ছবিটির ভূয়সী প্রশংসাও করেছিলেন। অর্থাৎ, যে-ছবি আন্তর্জাতিক ফিল্ম-মানচিত্রে ভারতকে প্রতিষ্ঠা দেবে, ঘটনাচক্রে সেই ছবিটির সঙ্গেও অন্তত ভাবনাগত দিক থেকে জড়িয়ে পড়েছিলেন দেবকী বসু! সাধে তাঁকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ বলা হয়। তবে শুধু পথিকৃৎ বললে বোধ হয় তাঁকে পুরোপুরি সম্মান জানানো হয় না। তিনি ভারতীয় ছবির মুকুটহীন সম্রাট!
আরও পড়ুন: 'সন্ত্রাসবাদী' শক্তি অন্তর্ঘাত আনেন অতর্কিতে