তিনে শূন্য
শর্মিলা মাইতি রেটিং- * জল অনেক গড়িয়েছে। স্টার থিয়েটারে নাকি সরকার এ ছবির প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়েছে। এক মাথা কন্ট্রোভার্সির ব্যাগেজ নিয়ে ছবি রিভিউ করতে যাওয়া বেশ কঠিন। স্ক্রিপ্টে আবার নিজের চ্যানেল। চতুর্মুখী চাপ!
শর্মিলা মাইতি
রেটিং- *
জল অনেক গড়িয়েছে। স্টার থিয়েটারে নাকি সরকার এ ছবির প্রদর্শন বন্ধ করে দিয়েছে। এক মাথা কন্ট্রোভার্সির ব্যাগেজ নিয়ে ছবি রিভিউ করতে যাওয়া বেশ কঠিন। স্ক্রিপ্টে আবার নিজের চ্যানেল। চতুর্মুখী চাপ!
শুরুতেই বেশ মোটা অঙ্কের ধারকর্জ করে বসেছেন পরিচালক। স্বনামধন্য সত্যজিত্ রায়ের কাল্ট ছবির নাম। কম সে কম তিনটি কন্যা তো রাখতেই হবে, না হলে মান থাকে কই! এক কন্যা ডিস্কে নাচেন, এক কন্যে গোলি মারেন, এক কন্যে ২৪ ঘন্টায় খবর পড়েন। পার্ক স্ট্রিট প্লট ফিট। কিন্তু অত কী হবে সিধে। রাডিক্যাল কমেন্টস শুনলেই সরকার খেপে যাবে। কাজেই পার্ক স্ট্রিট হয়ে যায় সাব-প্লট। তাহলে প্লটটা কী? সারা ছবি হাতড়ালেও পাবেন না। অত প্রশ্ন করবেন না, তিন কন্যের এক কন্যে কিন্তু স্কিত্জোফ্রেনিক...আপেল-কাটা ছুরি দিয়েই অ্যাটাক করবেন। ঘাবড়ে গেলেন নাকি? সরল করেই বলি, তিন কন্যা এমনিই এক ছবি, যেখানে তিন ছাড়াও সিকি-আধুলি এক আনা তিন আনা কন্যেরাও আছেন। আগে এলে ভাগ পাবেন বেসিসে তাঁরা স্ক্রিপ্টে দিব্য জায়গা করে নিয়েছেন। নিরন্তর ছিঁচকাঁদুনির সুযোগ পেয়েছেন। এঁরা কেউ কন্যেদের মা, মেয়ে কিংবা কাজের মেয়ে। (কেউ লক্ষ করেছেন কি না জানা নেই, এ ছবিতে কাজের মাসিদেরও একটা সবিশেয ভূমিকা আছে। এঁরা একের কথা অন্য বাড়ি চালান করেন, মালকিনের এডস হয়েছে শুনলে চাকরি ছেড়ে দেন, ইত্যাদি)
ধার-কর্জের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম...পার্ক স্ট্রিটের রেপ ভিকটিম-এর আদলে বানানো চরিত্রটাও ধার করা। যদি তদনীন্তন পুলিশ কমিশনার দময়ন্তী সেনের আদলে নবাগতা উন্নতির চরিত্রটা ভাবা হয়, তাহলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, বাস্তবের প্রতি কোনও সততাই দেখাননি পরিচালক। রেপ ভিকটিম ছবিতে হয়ে গিয়েছেন দেহ-পসারিণী। প্রোমোতেও কানে হাতুড়ি পেটানো সব সংলাপ- আমার ছেলে হয়ে একটা প্রস্টিটিউটের সঙ্গে সেক্স করতে গেলে কন্ডোম ইউজ করতে হয় জানো না!.. নাঃ, একটুও হজম হয় না। পুলিশ অফিসার কন্যের আবার চিতার মতো চোখ। ইলেকট্রিক আইল্যাশ। নরুনের মতো চোখা নাক, হাঁটলে মনে হয় জীবন্ত তালপাতার সেপাই। বন্দুকের বদলে চোখ দিয়েই গুলি মারেন। একটি ভঙ্গিমাতেও পুলিশ অফিসারসুলভ দার্ঢ্য নজরে আসে না। মোটের ওপর, নারী, সেক্স, রেপ, নারকোটিকস সবই যেন এক দরে বিক্রি হয়ে গিয়েছে মনে হয়..
বিক্রির কথা যখন উঠলই, এ ছবি বানানোর আগে বোধহয় একটা জিনিসই মাথায় রেখেছিলেন পরিচালক। বিক্রয়যোগ্যতা। গল্পটা বুঝে উঠতে না পারলে, একটু অন্যরকমভাবে ভাবলেই বুঝতে পারবেন, কেনই বা মিডিয়া পার্টনার চ্যানেল অহেতুক এত বেশি স্ক্রিনটাইম জুড়ে থাকে। কেনই বা পিসিআর রুমে অহেতুক গালিগালাজের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়, অ্যাঙ্কর-কন্যে কেনই বা এত অসম্ভব টাইট রাতপোশাক পরেন, কেনই বা পুলিস অফিসারকে প্রায়শ স্লিভলেস কিংবা নুডল-স্ট্র্যাপ ড্রেসে দেখা যায়। কেনই বা কুড়ি সেকেন্ডের জন্য শ্যামসুন্দর জুয়েলারী শপের বিজ্ঞাপন করেন সুদীপ ও ঋতুপর্ণা অভিনীত দুই চরিত্র, কেনই বা রণদেব বসুর চরিত্র হঠাত্ ঢুকে পড়ে শুধুই এক নায়িকাকে বৃষ্টিতে ভেজানো আর সুইমিং পুলে স্নান করানোর জন্য। এই অজস্র কেন-র একটাই সঠিক উত্তর- ছবিটা বেচতে হবে।
এবার চিত্রনাট্য। সেরা ভিলেনের নমিনেশনও পেতে পারে, বলা যায় না! ছোট বাচ্চাদের কোনওদিন জিজ্ঞেস করেছেন, বল তো সোনা, রাতে কী স্বপ্ন দেখলে... উত্সাহে তাহলে দেখবেন কাহিনির ভেতরে কুকুরছানা থেকে এরোপ্লেন সবই ঢুকে পড়ছে, গল্প থামতেই চাইছে না। এ ছবির স্ক্রিপ্টরাইটার প্রোমোশনের সময়ে বলেছিলেন, রাতের পর রাত জেগে স্ক্রিপ্ট লিখেছেন, বহু সবধানতা অবলম্বন করে। অত রাত না জেগে ভোরের দিকে ফ্রেশ মাইন্ডে লেখালিখি করলে বক্তব্যটা একটু গুছিয়ে নিতে পারতেন। দর্শকের কাছে একরকম একটিকিটে দুটো ফিল্ম দেখার সমান। দেড় ঘন্টা পর ব্রেক আর ব্রেকের পর যে গল্পটা শুরু হয়, তার সঙ্গে আগেরটার সুদূর সম্পর্ক নেই। এই পর্বটায় আবার ক্রেডিটলাইন না দিয়েই ধার করেছেন রাম গোপাল ভার্মার কাল্ট ফিল্ম কৌন থেকে। ভাল অভিনয় করেছেন ঋতুপর্ণা সন্দেহ নেই। তবু হল থেকে হাসির শব্দও নেহাত কম ছিল না। সেমসেক্স, স্কিজোফ্রেনিয়া, এডস, ঝাড়পিট সহযোগে যে জাল বুনেছেন, যে তার প্যাঁচে নিজেই আটকে গেলেন চিত্রপরিচালক আর চিত্রনাট্যকার!
অথচ আর একটু সত্সাহস দেখাতে পারলে, আর একটু সত্যানুসন্ধানে মন দিলে নিঃসন্দেহে একটি মনে রাখার মতো ছবি হতে পারত। গিমিকের পর গিমিক দিতে হত না। অনন্যা চট্টোপাধ্যায়ের মতো বলিষ্ঠ সাহসিনী অভিনেত্রীর মুখ বন্ধ করে দেওয়া হল এডসের লাল ফিতে দিয়ে! তিন কন্যের মধ্যে ইনিই সবচেয়ে সাইডলাইনড। অথচ সবচেয়ে পজিটিভ একটি চরিত্র। আর অবশ্যই, মনে রাখার মতো ক্যামেরার কাজ শীর্ষ রায়ের।
এ ছবিকে বাঁচিয়ে তোলার জন্য এক ‘মমতা’-ময়ী হাতের ছোঁয়াই প্রয়োজন হয়েছিল। তালেগোলে সেটা ‘হওয়ানো’-ও হল! এমন কাগের ঠ্যাঙে বগের ঠ্যাঙে ছবিও তাঁর দাক্ষিণ্যেই দাঁড়িয়ে গেল! বিশ্বাস করুন, বিতর্কের ঢক্কানিনাদ ছাড়া এ ছবিকে হেঁইয়ো-টান দেওয়া মুশকিল নয়, নামুমকিন ছিল। সাকসেস সেলিব্রেশনের আগে পরিচালক একখানি ফুলের তোড়া পাঠাবেন মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীকে। অতি অবশ্যই!