বাঙালির পুরুষ কণ্ঠে আর পৌরুষ থাকবে কি!

Updated By: Dec 30, 2015, 04:14 PM IST
বাঙালির পুরুষ কণ্ঠে আর পৌরুষ থাকবে কি!

স্বরূপ দত্ত

সুবীর সেন প্রয়াত। বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। বাংলা এবং হিন্দিতে এমন অসংখ্য গান গেয়েছিলেন, যা কোনওদিন ভুলবে না মানুষ। সুবীর সেন চলে যাওয়ার দিন এভাবেই চ্যানেলগুলো 'জীবন জার্নি'টা 'কনক্লুড' করে দিল তাঁর। পরের দিনের কাগজে ১০০ শব্দ কিংবা ডোরিক! তাই মনে হল, কিছু কথা বলার দরকার। কে ছিলেন এই সুবীর সেন? কেন তাঁর মৃত্যুর দিন বা পরের দিন আমাদের মতো বাঙালিদের আরও কটা কথা বলার। তাই সামান্য কিছু শেয়ার করা। ৮১ বছরের মানুষটা দেখতে বড্ড সুন্দর ছিলেন। সবাই জানেন। মানুষটার গলায় জাদু ছিল। এটাও শোনা কথা। তিনি হিন্দিতে যখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখন এত সহজ ছিল না, সেখানে রাজ করা। তবু তিনি করেছেন। কীভাবে? কী এমন ছিল তাঁর? সেগুলোই একটু শেয়ার করা।
আজ সকালে দু'জনকে বাছলাম, সুবীর সেন চলে গেলেন, কতটা দুমড়ে গেল বুকটা তাঁদের, সেটা জানার জন্য।

এক, সৈকত মিত্র। কেন? শ্যামল মিত্রর ছেলে। সুবীর সেনের সমসাময়িক শ্যামল মিত্র। তাই ছেলেবেলা থেকেই খুব কাছ থেকে সুবীর সেনকে দেখেছেন সৈকত। আর বাবার বন্ধু হওয়ার পরও সুবীর সেন কখনও সৈকত মিত্রের সুবীর কাকু ছিলেন না! বরাবর ছিলেন সুবীর দা! একটা মানুষ মনের বয়স কতটা আটকে রেখে দিতে পারলে, সবার দাদা হয়ে ওঠা যায়! সেই সৈকত মিত্রের গলাও যেন সকালে বুঁজে আসছিলো। ব্যথা-বেদনার কাহিনি তো বললেনই। কত স্মৃতি তাঁর। ট্রাইঙ্গুলার পার্কের ওই বাড়িটার নিচের তলায় কত উঁচু দিনগুলো তাঁদের কেটেছে একসঙ্গে, মনে করছিলেন। পরে গলফ গ্রিনে চলে গেলেও, ওই দিনগুলো মলিন হওয়ার নয় কোনওদিনও।
 
সৈকত মিত্র শোনাচ্ছিলেন, 'একবার হল কী, আমরা একটা ক্যাসেট বের করছিলাম। বিষয় হেমন্ত শ্রদ্ধাঞ্জলী। তা, সুবীর দাকে দিয়ে গাওয়ানোর কথা, এই রাত তোমার আমার। সুবীর দা তো এলেন সকালবেলায়। কিন্তু এসে পর্যন্ত ওই যা হয় আর কী! আজ গলাটা ঠিক ভালো নেই। বসে গিয়েছে। আর এই গানটা হেমন্ত দার একার গান। এ গান আমি কী গাইবো। এই সব বলতে লাগলেন। মাঝে-মাঝে চা চলছিল। দু'-আড়াই ঘণ্টা দিব্যি গল্প করে কাটিয়ে দিলেন সুবীর দা। কিন্তু গানটা রেকর্ডিং করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই! কতবার বললাম, ও সুবীর দা, শুধু গল্পই করবে? গানটা গাইবে না? না, তখনও গানটা গাইলো না! আরও সময় বয়ে গেল। কিন্তু বাড়ি চলে যাওয়ার আগে গানটা রেকর্ডিং করে দিয়ে গিয়েছিলো। আজও বিশ্বাস করি, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়া এই রাত তোমার আমার এত ভালো কেউ গাইতে পারবে, এই বিশ্বাসের এমন প্রমাণ সেদিন পাবো, বুঝতে পারিনি।' সৈকত মিত্রের গলায় তাঁর প্রিয় সুবীর দার চলে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পরেও মুগ্ধতার রেশ কাটেনি এক ফোঁটাও।

এবার আসি দ্বিতীয় মানুষটার প্রতিক্রিয়ায়। কল্যাণ সেন বরাট। তাঁর সুরেও গান গেয়েছিলেন সুবীর সেন। তাই অনেক অনেক স্মৃতি। সাঁঝ সকালেও গলা জড়িয়ে আসছিল কল্যাণ সেন বরাটের। নিজের অভিব্যক্তি চেপে না রাখতে পেরেই বলছিলেন, নক্ষত্র পতন। আর আপনার ভালো লাগা? জিজ্ঞেস করলাম। বললেন যা, 'শিবদাস দা-র লেখায়, আমার সুরে একটা গান গাওয়ার কথা ছিল সুবীর দার। গানের কথা ছিল, আহা পিয়ানো আমার প্রেম...। এইচএমভি থেকে গানের রেকর্ডিং তো হয়ে গেল। কিন্তু গানের ভিডিও শুটের সময় বেশ মজা হয়েছিল। আসলে সুবীর দা তো খুব রসিক আর আড্ডাবাজ লোক ছিলেন। তাই শুটিংয়ের সময় আমায় বললেন, পিয়ানোটায় বসতে। আর তিনি আমার পাশে দাঁড়িয়ে গান গাইলেন। বড্ড এনকারেজ ছিলো, ওই ছোট ছোট ব্যবহারগুলোয়। মিস করব।'

এবার আসি নিজের কিছু প্রতিক্রিয়ায়। ঠিক কত বড় গায়ক ছিলেন সুবীর সেন? সাধারণত, দু ধরনের ক্রিয়েটিভ মানুষ হন। একদল এমন কঠিন কিছু কাজ করতে পারেন, যেগুলো একেবারেই তাঁর নিজস্ব পেটেন্ট! ওগুলোর জন্যই তাঁরা পূজিত হন। শ্রদ্ধেয় হন। বাকিরা হাজার চেষ্টা করেও ওই কাজগুলো করে উঠতে পারেন না। আর একদল ক্রিয়েটিভ মানুষ এমন হন, যাঁরা বিরাট কঠিন কিছু করেন না। বরং, বড্ড সোজা জিনিসগুলো করে যান। যেগুলো সবাই করেন। কিন্তু ওই সোজা জিনিসগুলো এমন দক্ষতায় আর অবলীলায় করে যান যে, আর কারও পক্ষে অত সোজা করে ওই সহজ কাজটা করা হয়ে ওঠে না। সুবীর সেন ছিলেন এই দ্বিতীয় সারির শিল্পী। যিনি কঠিন গান গেয়ে মানুষের মস্তিষ্কে বসে যাননি। বরং, তিনি সহজ-সরল গানগুলো গেয়ে মানুষের মনে থেকে গিয়েছেন। শুধু গলার স্বরে রোম্যান্টিকতার একটা অবয়ব এঁকে গিয়েছেন।

আচ্ছা, আপনি পুরুষ মানুষ? আপনার কাছে পৌরুষ কী? জানি না, আপনার উত্তর কী। তবে, এই পৃথিবীর বেশিরভাগ নারী, তাঁর প্রিয় পুরুষ বাছার সময়, কণ্ঠস্বরকে একটু বেশিই গুরুত্ব দেন। নারীর কাছে পুরুষের পৌরুষ তাঁর কণ্ঠস্বরে। সুবীর সেন হল বাঙালির সেই পৌরুষের প্রতীক কণ্ঠ। আমাদের দেশে লতা মঙ্গেশকর বরাবরই কেমন যেন দেবী দেবী। তাঁর সাদা পোশাকে সামান্য রঙ ভরতে সবারই বড্ড তীব্র অনীহা। কিন্তু কোকিলকণ্ঠীরও যে মন হয়। একবারই হোক অথবা নীরবেই হোক, তাঁর জীবনেও তো প্রেম আসার কথা জীবনের স্বাভাবিক গতিপথেই। আমাদের দেশে যে লতা মঙ্গেশকরকে দেবীর আসনেই বসিয়ে রাখা হয়েছে, সেই লতার জীবনের সঙ্গে দুজন পুরুষকে কখনও কখনও জড়ানোর ফ্যান্টাসি দেখাতে পেরেছে আমাদের 'নাবালক মিডিয়া'। শুনবেন না, নাইটিঙ্গলের মনে জায়গা পেয়েছিলো কোন দুই পুরুষ? এক, রাজ সিং দুঙ্গাপুর! দুই, আমাদের সুবীর সেন! আবার আর একবার লাইনটা পড়ুন। তারপর চোখ বুজে অনুভব করুন। আর ভাবুন, সুবীর সেন তাহলে কী! যে পুরুষ অথবা পুরুষ কণ্ঠ নিয়ে লতা মঙ্গেশকরের মনেও প্রেম আসে, সেই পুরুষকে জানার জন্য আর একটু হ্যাংলামো করব না? সেই পুরুষকে নিয়ে আর একটু গর্ব করব না?ইউটিউবে গিয়ে একটা বার ক্লিক করে শুনবো না, পাগল হাওয়া!

পাঁচের দশকের শুরুতে শঙ্কর জয়কিষেণ যখন সুবীর সেনকে বাংলা থেকে বম্বেতে নিয়ে গেলেন, তখন লতা মঙ্গেশকর পর্যন্ত বাঙালি গায়ক সুবীর সেনের প্রেমে পড়েছিলেন। এমনটাই গল্প চাউর হয়েছিল সেই সময়। (পাঁচ এবং ছয়ের দশকে এই কথা খুবই চাউর হয়েছিল) হবে নাই বা কেন? সেই সময় বম্বেতে রাজ করছেন মহম্মদ রফি। সঙ্গীত জগতে রফি সাহাবের অনুগামীর অভাব ছিল না। সেই অনুগামীরা তখন উঠে পড়ে লেগেছিলো সুবীর সেন আর হেমন্ত কুমারকে বম্বে ছাড়া করার জন্য! আরও একবার ভাবুন, সুবীর সেন কী! যার গলায় ভয় পেয়েছিলো কিনা মহম্মদ রফি অনুরাগীরা! এ যেন, স্টেফির ভক্ত তাই মনিকা সেলেসের পিঠে ছুরি মারা! এ সবের প্রমাণ হয়তো নেই। কিন্তু সব সত্যির প্রমাণ দিতেও হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে?
বাংলা গানে পরে আসছি। কখনও হিন্দিতে শঙ্কর জয়কিষেনের সুরে শুনে দেখবেন, 'ম্যায় রঙ্গিলা প্যার কা রাহি...' তখনকারদিনে মেহেবুব খুব জনপ্রিয় অভিনেতা ছিলেন। তাঁর অভিনয়ে সুবীরের কণ্ঠ গোটা দেশের যুবসমাজের বুকে প্রেমানুভূতি এনে দিয়েছিল। এমনই অসংখ্য গান। কখনও লিপ দিয়েছেন ধর্মেন্দ্র কখনও বা জয় ব্যানার্জি।ওই হিন্দি গানে দুলে উঠেছিল দেশ।

সলিল চৌধুরি বরাবরই খুব ভালোবাসতেন সুবীরকে। কারণ, খুব সহজ। সুবীরের থেকে সহজ করে আর কে প্লে ব্যাক গাইবেন!তাই তো লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে হিন্দিতে গাইয়েছিলেন 'না জানে কিউ, হোতা হ্যায় ইয়ে জিন্দেগিকে সাথ...আচানক ইয়ে মন....'আর বাংলায় পাগল হাওয়া গাওয়ালেন সুবীর সেনকে দিয়েই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দেখতে মানুষটার গলা সত্যিই এমন সুন্দর ছিলো। রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন খুব ভালো। অনুভবে তাঁর গাওয়া সেদিন দুজনে...আজও মানুষ গুনগুন করে। সারাদিন তোমায় ভেবে, হল না আমার কোনও কাজ, হল না তোমাকে পাওয়া, দিন যে বৃথা গেল আজ! এ কথায় কণ্ঠ সুবীর সেন দেবেন না তো কে দেবেন? বাঙালির এই সেন টাইটেলটার সঙ্গে একটা ফ্যান্টাসি আছে চিরকাল।

যদি ধরে নিই, সেনেদের নারী মুখ সুচিত্রা আর অপর্ণা। তাহলে বলতেই হবে, সেনেদের পুরুষ কণ্ঠ হল সুবীর। গতকাল সেই সুবীর সেনই চলে গেলেন। বাঙালি হয়তো থেকে যাবে আরও কয়েক শতক। কিন্তু বাঙালি পুরুষের কণ্ঠে সহজাত এই বীরত্বটা আর থাকবে কি? মনের উত্তর যে বড় নেগেটিভ। আসলে বাঙালি পুরুষ বড় সহজ-সরল। একটা পাঞ্জাবি, একটা পাজামা বা ধুতি একটা বাড়ি, একটা সংসারে বিশ্বাসী। বাঙালি পুরুষের চরিত্রটা ফুটে উঠত ওই গলায়। এর থেকে কারুকার্য করা কণ্ঠ বাঙালি পেয়েছে অনেক। কালও পাবে। কিন্তু তাতে যে আর 'সুবীর সারল্য' থাকবে না। আর শেষবেলায় দুটো কথা। চলে যাওয়ার দিনটাও কী বেছে গেলেন! রাজেশ খান্না জন্মেছেন যে ২৯ ডিসম্বর, সুবীর সেন চললেন সেই ২৯ ডিসেম্বর। রাজেশ খান্না দেশের প্রথম মেগাস্টার, যুবসমাজের মুখ। আর সুবীর সেন বাঙালি পুরুষের স্বর! অভিমানী গলাতেই গেয়ে গিয়েছিলেন, এত সুর আর এত গান, যদি কোনওদিন থেমে যায়, সেই দিন তুমিও তো ওগো, জানি ভুলে যাবে যে আমায়...। হয় কখনো! ধুর! কে ভুলবে! যাঁরা আজ সুবীর সেনকে ভুলছে, তাঁরা তো জানতোই না মানুষটাকে।

.