‘অপু হতে চাই’

হেসে বললেন, ‘তা বেশ তো, বড় হয়ে কী হতে চাও?’  সপাটে বললাম, ‘অপু হতে চাই।’ 

Updated By: May 2, 2019, 04:27 PM IST
‘অপু হতে চাই’

শর্মিষ্ঠা গোস্বামী চট্টোপাধ্যায়

সালটা সম্ভবত ১৯৮৬। আমার বয়স তখন বারোর দিকে।মফস্বলের মেয়ে। আনন্দমেলার পাশপাশি বাড়িতে আসত সন্দেশ। লীলা মজুমদারের সঙ্গে আলাপ হয়াছে আগেই। এমনকী সত্যজিতের সঙ্গেও। নলিনী দাশের লেখা একটু একটু করে পড়ছি। গণ্ডালু ক্রমেই প্রিয় হয়ে উঠছে। এমন এক সময়ে, হঠাত্‍ই বাবা বললেন, ‘সত্যজিত্‍ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবি?' আমার ছোট থেকেই সেলিব্রিটি নিয়ে মোহ কম। তাই খানিক নিমরাজি হয়েই বাবার সঙ্গে রওনা দিয়েছিলাম ট্রেনে চেপে। মনের মধ্যে আশা ছিল এই যে, একবার যদি দেখতে পাই, কীভাবে স্কেচ করেন! আমি আগে থেকেই জানতাম, তিনি বাড়ির দরজা নিজে খোলেন, টেলিফোন নিজে ধরেন ইত্যাদি। 

অ্যাপয়েন্টমেন্ট করাই ছিল। যেমনটা ঘটার ঠিক ঠিক তেমনটাই ঘটল। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি লম্বা মানুষটি দরজা খুললেন, স্মিত হাসলেন, ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। মিষ্টি-জল এল। কথা বলছিলেন একেবারে বন্ধুর মতো করে। যখন জিগ্যেস করলাম, ‘আপনার রহস্য-রোমাঞ্চ লেখায় মেয়েরা থাকে না কেন? ফেলুদা আর তোপসের সঙ্গে মেয়েদের কোনও গল্পের ট্র্যাক থাকতে নেই!’ হেসে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই অভিযোগটা কিম্তু ক্রমশই বাড়ছে। তুমি গণ্ডালু পড় না?’ বললাম, ‘পড়ি। কিন্তু ফেলুদা তো আরও বিখ্যাত। আমার বন্ধুরা বেশি করে ফেলুদা পড়ে। সেখানে তোপসের একটা বন্ধু হলে মন্দ হয় না।’ আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন। বাবা সাত

তাড়াতাড়ি তাঁর বিদ্রোহী কন্যাকে থামানোর জন্য অন্য প্রসঙ্গ পাড়লেন। সীমাবদ্ধ ছবির প্রেক্ষিতে ট্রেড ইউনিয়ন মুভমেন্ট, বরুণ চন্দকে খুঁজে পাওয়া। ধৈর্য ধরে সব প্রশ্নের উত্তরই দিচ্ছিলেন খুব নিচু স্বরে। আমার চোখ স্থির ওঁর হাতের দিকে। কলমের কারিকুরিতে ফুটে উঠছে অবয়ব। যেন একটা স্টোরি-বোর্ড। আমার  প্রশ্ন,’আগে লেখেন,নাকি আগে আঁকেন?’ বললেন, ‘তা তো জানি না, লেখা আগে এলে লিখি। আবার কখনও কখনও ভাবনাটাও এঁকে রাখি। সবটা লেখা হয় না, এমনিই থেকে যায়।‘  

এমন সময়ে বাবা বলে উঠলেন, ‘তোমার কথাটা বলো।’ ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আমার অপরাজিত খুব ভাল লেগেছে। পথের পাঁচালির থেকেও ভাল। বাবাকে বলেছি, আমিও বড় হয়ে কলকাতার কলেজে পড়ব। অপুর মত করেই নিজে দেখব শহরটাকে। অপু নিশ্চিন্দিপুরে থাকলেও ওর একটা আর্বান মন আছে।’ হেসে বললেন, ‘তা বেশ তো, বড় হয়ে কী হতে চাও?’  সপাটে বললাম, ‘অপু হতে চাই।’ 

ফিরে আসার আগে হাতে দিয়েছিলেন তখনকার আঁকিবুঁকি কাটা ছবিটা। গল্পের ফাঁকে সে যে কখন অবয়ব ধরে ফেলেছে, আমি খেয়ালও করিনি। একটা সন্দেশ পত্রিকা নিয়ে গিয়েছিলেম, অটোগ্রাফ নেব বলে। তার আর দরকার হয়নি, ছবির কোনায় সই- সত্যজিত্‍ রায়। আগামী বছর শতবর্ষের সূচনা। আমরাও নিশ্চয়ই ঝাঁপিয়ে পড়ব তাঁকে নিয়ে। তার আগে প্রায় দশ বছর পর একবার পুরনো বাক্স থেকে বের করতে হবে ছবিটা। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিত্‍- এই আঁকিবুঁকির ছবিতে আমার কাছে সবথেকে আকর্ষণীয়, রোমাঞ্চে ঘেরা বাঙালির দুই সেরা মস্তিষ্ক। শহুরে বাঙালির ‘মানিকদা’কে আমি চিনি না।
 

 

Tags:
.