রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর', তা হয়তো আজও ঠিক বোঝা গেল না!
আজ, ২৪ নভেম্বর জন্মদিন রবি ঘোষের। বেঁচে থাকলে ৯১ বছর বয়স হত!
সৌমিত্র সেন
ধনঞ্জয়, না বাঘা? কে কাকে হারাল? নাকি, কেউ কাউকে না হারিয়েই সমান্তরাল ভাবে দু'জনেই বাঙালির ফিল্ম-ফ্যানটাসির দুনিয়ায় পেতে রাখল অক্ষয় সাম্রাজ্য?
বোধ হয় তাই! ফ্যানটাসিই তো। ফ্যানটাসির চূড়ান্ত। 'গল্প হলেও সত্যি'র ধনঞ্জয় বা 'গুপী বাইন বাঘা বাইন'-এর বাঘারূপী রবি ঘোষ দস্তিদার তো বাংলা ছবির নিছক একজন কৌতুকাভিনেতা নন, তিনি তো অমোঘ কিছু ফ্য়ানটাসির জন্মদাতাও। ধনঞ্জয় যা করে, যেভাবে করে তা কি সাধারণ ভাবে কোনও চাকর-নফর ব্যক্তি পারে? কিম্বা, বাঘা ঢোল বাজাতে-বাজাতে জীবনের ছন্দে যে স্বপ্ন-রিদিম সরবরাহ করেন, তা কোনও গ্রাম্য ঢোলবাদকের কম্মো নাকি?
১৯৩১ সালের আজকের দিনে কলকাতায় জন্ম রবি ঘোষের। আশুতোষ কলেজ থেকে স্নাতক। ব্যাঙ্কশাল কোর্টে বছরছয়েক কাজও করেন। কিন্তু কারুবাসনা তাঁকে নিশ্চয়ই পেড়ে ফেলেছিল। না হলে নিশ্চিন্ত চাকরিজীবন ছেড়ে, শান্তস্নিগ্ধ সংসারজীবন ছেড়ে কেন তিনি মঞ্চের আলো-আঁধারিতে বারবার এসে দাঁড়াবেন! ওই পোকাই তাঁকে ক্রমশ আরও অ্য়াচিভমেন্টের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল।
তিনি খুঁজেও নিলেন তাঁর নতুন দিগন্ত। মঞ্চ ছেড়ে, কিংবা মঞ্চের পাশাপাশি তিনি এসে দাঁড়ালেন ক্যামেরার সামনেও। তখন কী হল? শিল্পতৃষার যে চূড়ান্ত দিগন্ত একজন স্রষ্টা ছুঁতে চান, তা থেকে তাঁকে বঞ্চিত করে তাঁকে নিরন্তর দাগিয়ে দেওয়া হতে থাকল 'কমেডিয়ান' তকমায়।
হ্যাঁ, কৌতুকাভিনেতা তিনি নিশ্চয়ই। অসাধারণ 'টাইমিংয়ের' একজন বিশ্বমানের কৌতুকাভিনেতা। কিন্তু পাশাপাশি তো তিনি একজন মেথড অ্যাক্টরও, একজন অসামান্য চরিত্রাভিনেতাও। অথচ বাঙালি অতি সাধারণ মানের ছবিতেও দৃশ্যে-দৃশ্যে তাঁর ওই মসৃণ অভিনয়ের উচ্চতাকে যেন ঠিক গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে পারল না। বা, বলা ভাল বুঝতে চাইল না।
ফিল্মজীবনের একটা-পর্বে সত্যজিতের ছবির নিয়মিত সদস্য রবির প্রথম ছবি 'আহ্বান' (১৯৫৯)। তবে ১৯৬৬ সালে তপন সিনহার 'গল্প হলেও সত্যি'ই তাঁকে যথাযথ প্রতিষ্ঠা দিল। এই ছবির ধনঞ্জয় চরিত্রটা যেন একটা 'এসকেপ পয়েন্ট'। হয়তো সব সময় সকলের সংসারযাত্রায় তা মেলে না, কিন্তু মেলার একটা স্বপ্নসম্ভব আবহ তৈরি করে দেয়। একটা অন্যরকম আদর্শের কথা বলে চরিত্রটি। কঠিন একটি চরিত্রকে কী অনায়াসে যে রবি পর্দায় সত্য করে তোলেন!
সত্যজিতের 'গুপী বাইন বাঘা বাইন' (১৯৬৮), 'অভিযান', (১৯৬২) 'অরণ্যের দিনরাত্রি' (১৯৭০), 'হীরক রাজার দেশে' (১৯৮০), 'গুপী বাঘা ফিরে এল' (১৯৯১) তাঁর বিচিত্র অভিনয়প্রতিভার স্বাক্ষর। গৌতম ঘোষের 'পদ্মানদীর মাঝি'তেও (১৯৯৩) তাঁর অভিনয় তাঁকে একটা অতুলনীয় পর্যায়ে তুলে দেয়। এমনকি 'মহাপুরুষে' বিরিঞ্চিবাবার চেলার রোলটিও যেন তাঁকে ছাড়া ভাবাই যায় না!
কিন্তু সত্যজিৎ-তপন-গৌতমের বাইরে? সেখানেই বরং রবি ঘোষের প্রকৃত সাম্রাজ্য, প্রকৃত অধিষ্ঠান! 'প্রকৃত' কেন না, ফিল্ম-বাফ নয় কিন্তু সিনেমাপ্রেমী আমবাঙালি তো আমর্ম মজে থাকে 'মণিহার' (৬৬), 'কাল তুমি আলেয়া' (৬৬), 'বাঘিনী' (৬৮), 'বসন্ত বিলাপ' (৭৩), 'ফুলেশ্বরী' (৭৪), 'চারমূর্তি' (৭৮), 'বাঞ্ছারামের বাগান' (৮০)-য়ে! 'শ্রীমান পৃথ্বীরাজে'র হরিদাসকে কে ভুলতে পারে? যে-হরিদাস গান গাইতে-গাইতে বুলবুলভাজা বেচে। সে-ও তো স্বপ্ন বেচা!
ছবির পাশাপাশি আজীবন রবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন নাট্যভিনেতাও। 'চলাচল' নামের একটি নাট্যদলও গড়েছিলেন তিনি। 'অঙ্গার' নাটকে তাঁর অসাধারণ অভিনয় সাড়া ফেলে দিয়েছিল। দু'টি বাংলা ছবিও তিনি পরিচালনা করেছিলেন।
কিন্তু বাঙালি তাঁর অ্যাচিভমেন্ট অত মনে রাখে না। বাঙালির কাছে তিনি ভাঁড়, তিনি কমেডিয়ান, তিনি দৃশ্যের পর দৃশ্যে শুধু কৌতুকের জন্মদাতা!
আরও পড়ুন: '৩ বছর ধরে যৌনতা এড়িয়ে চলছি', সানা খানের সঙ্গে তুলনার পর জবাব সোফিয়ার