প্রাক্-শতবর্ষে Mrinal Sen: রুপোলি লাবণ্যের মৃণাল-ডোরে কখনও বাঁধা পড়েননি পদাতিক
বাংলা সিনেমার ক্লাসিক ট্রায়ো-- সত্যজিত-ঋত্বিক-মৃণাল। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর প্রয়াত হয়েছিলেন ট্রায়োর শেষজন-- মৃণাল সেন। মৃণাল সেন এবার শতবর্ষের দোরগোড়ায়। ১৯২৩ সালের জাতক ৯৯ বছর পার করে শতবর্ষে পা দিতে চলেছেন। আজ ১৪ মে তাঁর জন্মদিন।
সৌমিত্র সেন
যদি মৃণাল সেনের ছবি সম্বন্ধে এককথায় কিছু বলতে হয়, তবে 'অস্বস্তি' শব্দটা হয়তো চয়ন করা যেতেই পারে। মৃণাল-ছবি দেখলে দর্শকের এক প্রবল অস্বস্তি হয়। ছবি দেখার পর মনটা যেন ঠিক ভরে ওঠে না, একটা খামতি থেকে যায়, একটা কষ্ট কুরে কুরে খায়, মনের কোণে খোঁচা লাগে। বাঙালি ভদ্রলোকের তথাকথিত ভদ্রশান্তশিষ্ট ইমেজে যেন ঘা দিয়ে যায় মৃণাল সেনের ছবি।
আর এই আঘাতটা হানতে গিয়ে মৃণাল বেশ কিছু ঘুঁটি ব্যবহার করতেন। 'ঘুঁটি' বললে বিষয়টাকে অবশ্য একটু হালকা করেই দেওয়া যেন। বরং তিনি কতগুলি প্রকল্প নিয়ে 'ডিল' করতেন বলাই ভালো। যেমন অভাব, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, রাজনীতি। আর এ সবের সঙ্গেই তাঁর ছবির ভিতর-বাহিরে অন্তরে অন্তরে জড়িয়ে থাকত কলকাতা। মৃণাল নিজে কথাপ্রসঙ্গে 'ইনটেস্টাইনস অব দ্য সিটি' কথাটা একবার বলেছিলেন। 'শহরের অন্ত্র'! হ্যাঁ, অন্ত্রই তো; জড়ানো-প্যাঁচানো নানা গলিঘুঁজি, আলো-আঁধারি আলোড়ন ও স্তব্ধতা মাখা গলির গলি তস্য গলি নিয়ে এই কলকাতা শহরটা তার সমস্ত হাড়-পাঁজর-দাঁত সমেত কী তীব্র ভাবেই-না হাজির মৃণালের ছবিতে। ছবির পর ছবি জুড়ে কলকাতাকে কত ভাবেই-না দেখেছেন ও দেখিয়েছেন তিনি! লোডশেডিং, উনুনের ধোঁয়া, কার্নিস, মলিন বারান্দা, পলেস্তার-খসা নোনা দেওয়াল, বারোঘরের বারোয়ারি বাড়ি ও তার কেন্দ্রস্থিত শ্যাওলালাঞ্ছিত উঠোন, স্বপ্নভরা ছাদ-- ফ্রেমের পর ফ্রেম।
প্রায় একই সময়ে কাজ শুরু করলেও সত্যজিৎ রায়ের মতো ধ্রুপদী সাহিত্য আশ্রয় করে ফিল্ম তৈরিতে নামেননি মৃণাল। চিত্রসমালোচকেরা বলে থাকেন, বরং সত্যজিতের সৃজন-ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীতবিন্দু থেকেই মৃণালের ছবিযাত্রা। এ ব্যাপারটি সত্যজিৎও জানতেন, মানতেও। লিখেওছিলেন-- 'দে (Ritwik Ghatak and Mrinal Sen) ওয়্যার মেকিং ফিল্ম ভেরি ডিফারেন্ট ফ্রম মাইন, ভেরি ডিফারেন্ট, বাট ভেরি পাওয়ারফুল...।' ঋত্বিকের শিল্পভুবনও ছিল অন্যতর। এই দুই ভিন্ন রাজ-পথের মাঝে মৃণাল বরাবরই তার নিজত্বে স্থিত। তবে একেবারে প্রথম থেকেই নয়। তাঁর প্রথম ছবি 'রাত-ভোর' (১৯৫৫) বা দ্বিতীয় ছবি 'নীল আকাশের নীচে' (১৯৫৮)-তে যেন প্রকৃত মৃণালকে পাওয়া যায় না। ১৯৬০-এর 'বাইশে শ্রাবণ' থেকেই যেন মৃণাল সেন 'মৃণাল সেন' হলেন!
ছবির নান্দনিকতা বিষয়টিকে একটু অন্য ভাবেই দেখতেন মৃণাল। পরিমিত কথা, শব্দ, সুর, আবহ, চিত্রকল্পের মিশেলে তৈরি এক প্রায়-নিঁখুত শিল্পসৃজন সেই অর্থে কোনওদিনই অন্বিষ্ট ছিল না তাঁর। তিনি বরং খুঁতকেই তুলে ধরতেন, যা রুক্ষ , রূঢ়, অবিন্যস্ত সেটাকেই মসৃণতার প্রতিস্পর্ধী হিসেবে তুলে ধরতে পছন্দ করতেন। আর বুঝতে চাইতেন, খুঁজতে চাইতেন 'ফিজিক্যাল পিকিউলিয়ারিটজ'কে। সেটা তাঁর অন্যতম অস্ত্র হত। টেকনিক এবং কনটেন্ট দুটি ক্ষেত্রেই বিপুল ঝুঁকি নিতেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন। বস্তুত,'আর্ট ফর আর্ট'স সেক'-য়ে কোনও দিনই আস্থা রাখেননি মৃণাল; শিল্পকে নিঁখুত করে তোলার জন্য কোনও মাথাব্যথা ছিল না তাঁর, বরং যা বিশ্বাস করেছেন তাই নিয়েই ছবি করেছেন, বিশ্বাসকে মান্যতা দিয়েছেন সামগ্রিক অর্থেই।
কী বিশ্বাস করতেন মৃণাল সেন?
বিশ্বাস করতেন, যে কোনও ছবি-করিয়ের 'সবচেয়ে বড় সঙ্কট আদর্শগত'। তবে মৃণাল তাঁর আদর্শের বিষয়ে খুবই একাগ্র এবং সেটাকেই যে কোনও মূল্যে ছবির পর ছবিতে এক্সারসাইজ করে গিয়েছেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি বা শেষ থেকে গোটা সত্তর দশকের উত্তাল কলকাতা তার সামাজিক রাজনৈতিক অস্থিরতা অনবরত উঠে এসেছে তাঁর ছবিতে, এসেছে তাঁর আদর্শের ছাঁচের ভিতর দিয়েই-- ছবির শিল্পসাফল্যের খাতিরে কোনও ভাবেই এ থেকে বিচ্যুত হতেন না তিনি। ফলে, তাঁর ছবি কোনও দিনই সেই অর্থে জনচিত্তরঞ্জনী হয়ে ওঠেনি। 'বাইশে শ্রাবণ'-এর পর প্রায় প্রতি ছবিতেই তিনি এরকম-- এককাট্টা, ঠোঁটকাটা, একরোখা। 'ইন্টারভিউ', 'কলকাতা ৭১', 'পদাতিক', 'কোরাস'-- একের পর এক। বাঙালি মধ্যবিত্তের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, বাঙালি মধ্যবিত্তের দ্বন্দ্ব ও সাযুজ্য, তার স্ববিরোধ ও সংগতি-- সবই তাঁর ছবিতে বিশ্বস্ত চিত্রকল্পে নিটোল উঠে এসেছে। 'একদিন প্রতিদিন', 'আকালের সন্ধানে', 'খারিজ', 'খণ্ডহর', 'জেনেসিস' বা 'মহাপৃথিবী'র মতো ছবিগুলিতে নিষ্ঠুর আত্মসমালোচনা আর নিজেকে নিরন্তর প্রশ্ন করাও তো শুরু করেছিলেন তিনি।
নানা ভারতীয় ভাষায় গোটাআষ্টেক ছবি করেছেন। ওড়িয়া-য় 'মাটির মনিষ', তেলুগুতে 'ওকা উরি কথা', হিন্দিতে 'ভুবন সোম', 'এক আধুরি কহানি', 'মৃগয়া', 'খণ্ডহর', 'জেনেসিস', 'একদিন অচানক'। কেন এভাবে ভাষা থেকে ভাষা, সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতি, ভূগোল থেকে ভূগোলে ঘুরে বেড়িয়েছেন মৃণাল? নিজেই উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন-- 'আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন, আপনি কেন এত বিভিন্ন ভাষায় ছবি করেন? আমি বলি, আমি দারিদ্র নিয়ে ছবি করি। আফ্রিকাতে গিয়ে সোয়াহিলি ভাষায় ছবি করতেও আমার কোনও অসুবিধে হবে না, যদি আমি ফিজিক্যাল পিকিউলিয়ারিটিগুলি ধরতে পারি।'
আরও পড়ুন- Sandip Ray on Aparajito: পর্দায় বাবাকে খুঁজে পেলেন সত্যজিৎপুত্র,'অপরাজিত' দেখে আবেগতাড়িত সন্দীপ রায়