Manna Dey: তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড় হয়ে সেদিন বাংলা গানের ভূখণ্ডে আছড়ে পড়লেন প্রবোধচন্দ্র! কে তিনি?
১৯১৯ সালের ১ মে কলকাতায় জন্ম এই প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর। তারপর সাত দশকের বর্ণিল সাঙ্গীতিকজীবন তাঁর। উত্তুঙ্গ সাফল্যে স্পন্দিত।
সৌমিত্র সেন
ভিনরাজ্যে কেরিয়ার শুরু। মাত্র তেইশে। তার পরের দশটি বছর জুড়ে আরবসাগরতীরে বেশ কিছু মণিমুক্তোও ছড়িয়ে ফেলেছেন তিনি! কিন্তু স্বরাজ্যের গানভুবনে পা দিতে কিঞ্চিৎ দেরি হয়ে গেল তাঁর। যখন দিলেন, ততদিনে তাঁর সমসাময়িক পুরুষকণ্ঠ বাঙালিকে মুগ্ধ করে ফেলেছে।
কে তিনি?
তিনি প্রবোধচন্দ্র দে।
চিনতে পারলেন না? না, অবশ্যই তিনি এই নামে পরিচিত নন; তিনি ভারতীয় লঘুসঙ্গীতের জগতে সততই স্বরাট স্বনামধন্য মান্না দে।
কিন্তু নিজের 'আর্লি থার্টিজে' এহেন মান্না যখন বাংলায় গাইতে আসছেন ততদিনে জগন্ময় মিত্র হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য-- এই 'ট্রায়ো' মন জয় করে নিয়েছে বৃহত্তর বাঙালির। এঁদের রীতিমতো চেটেপুটে শুনছে বাঙালি। সেই সময়-পর্বেই তখন গাইছেন সুধীরলাল চক্রবর্তী, সত্য চৌধুরী, বেচু দত্তের মতো শিল্পীও। তবে এই তিনজনই বাঙালি শ্রোতাকে সেই সময়ে বেশি টেনে রেখেছিল। যাকে বলে দাপট, সেটাই ছিল এঁদের। আর ১৯৫০-এর দশকে সেই ত্রিমুখী সুরস্রোতেই এসে সেদিন মিশেছিল ১৯১৯-এর জাতক মান্না দে'র সুরের রামধনু।
১৯১৮ সালে জন্ম জগন্ময় মিত্রের। বাংলা আধুনিক ও নজরুলগীতির পাশাপাশি, ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুংরি, টপ্পা-সহ সঙ্গীতের নানা ধারায় ছিলেন স্বচ্ছন্দ। অসংখ্য কালজয়ী বাংলা গানের স্রষ্টা। ১৯৫০-এর আগেই তিনি রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত। ১৯৪৮ সালে রেকর্ড করা 'চিঠি--তুমি আজ কত দূরে' গানটি তাঁকে তখনই অমরত্ব দিয়ে দিয়েছে।
১৯২০ সালে জন্ম হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের। বাংলা ও হিন্দি দু'ধরনের গান দিয়েই কেরিয়ার শুরু। ১৯৫০-এর মধ্যে তিনিও যথেষ্ট চর্চিত, স্বীকৃত। এর মধ্যে আবার রবীন্দ্রসঙ্গীতেও ছাপ ফেলে দিয়েছেন। ১৯৫০-এর আগেই সলিল চৌধুরীর কথায়-সুরে হেমন্ত রেকর্ড করে ফেলেছেন 'গাঁয়ের বধূ'। এ গান দারুণ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। হেমন্তের এই রেকর্ড তখন ঘরে ঘরে বাজছে। এই গান হেমন্ত-সলিলকে জুটিকেও অভাবনীয় জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল।
১৯২২ সালে জন্ম ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের। এক অসাধারণ কণ্ঠশিল্পী। বাংলা গানের জগতে এক যুগন্ধর শিল্পী বলা চলে তাঁকে। ডিস্ক সঙ্স এবং বাংলা ছবির প্লেব্যাক মিলিয়ে তিনি ১৯৫০-এর মধ্যেই এক প্রায়-জ্যোতিষ্ক। এর উপর ছিল শ্যামাসঙ্গীতে তাঁর অসাধারণ সৃজন। এ হেন ধনঞ্জয় ১৯৪০ সালেই প্রণব রায়ের কথায় ও সুবল দাশগুপ্তের সুরে গেয়ে ফেলেছেন 'যদি ভুলে যাও মোরে জানাব না অভিমান'-এর মতো চিরভাস্বর গান।
ঠিক এই সাঙ্গীতিক আবহে, ১৯৫০-এর পরে, ১৯৫৩ সালে (ততদিনে 'দো বিঘা জমিন' ছবিতে অবশ্য সলিল চৌধুরীর সুরে গেয়ে ভারতবিখ্যাত) মান্না দে দু'খানি গান নিয়ে প্রবেশ করলেন বাংলা আধুনিক গানের জগতে-- 'কত দূরে আর নিয়ে যাবে বলো' এবং 'হায় হায় গো, রাত যায় গো'। এই গান শুনে জগন্ময়-হেমন্ত-ধনঞ্জয়মুগ্ধ শ্রোতাও সেদিন স্তম্ভিত, আলোড়িত। বাঙালিশ্রোতার একাংশ তখনও অবশ্য এই বলে একটু নাক সিটকেছিল যে, মান্না অনেকটাই 'বুড়ো বয়সে' বাংলায় গাইতে এলেন; তবে সামগ্রিক ভাবে দেখতে গেলে এই দুটি গান নিয়ে সেদিন মান্না দে'র বঙ্গ-অভিযান ছিল অনেকটা যেন 'এলেন, দেখলেন, জয় করলেন'-এর মতোই! এর দু'বছর পরেই মান্না দে নিজের সুরে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ১৯৫৬ সালে গাইলেন 'তুমি আর ডেকো না' এবং 'তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়'-এর মতো প্রাণকাঁদানো গান। ব্যস! আর ফিরে তাকাতে হল না তাঁকে। সেই যে বাংলা গানে তাঁর জয়যাত্রা শুরু হল তা ছবিতে-আধুনিকে মিলিয়ে টিকে রইল দশকের পর দশক ধরে।
গোবর গোহো (গুহ)-র আখড়ায় কুস্তির পাঠ নেওয়া মান্না দের সঙ্গীতজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৪৩ সালে হিন্দিতে 'তামান্না' ছবি দিয়ে। তারপর সাত দশকের সুদীর্ঘ বিস্তার। ২৪টি ভাষায় প্রায় ৪০০০ গান গেয়েছেন। ২০১৩ সালের অক্টোবরে মৃত্যু। তার আগে পর্যন্ত সৃজনের মধ্যেই ছিলেন বিরল প্রতিভাবান এই শিল্পী। ১৯৫০-এর মধ্যেই মুম্বইয়ে (তৎকালীন বম্বে) রীতিমতো নজর কেড়ে ফেলেছিলেন মান্না দে। 'তামান্না'র পরে'সোলো' গায়ক হিসাবে প্রথম খ্যাতি লাভ করেন 'রামরাজ্য' ছবিতে। এ ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন 'গায়ি তু তো গায়ি সীতা সতী'। দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল এটি। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৪৩ সালে (শোনা যায়, সারা জীবনে মাত্র একটিই ছবি দেখেছিলেন গান্ধীজি, আর সেটি ছিল এই 'রামরাজ্য')। এরপর ১৯৫০ সালে শচীনদেব বর্মনের সুরে 'মশাল' ছবিতে গাইলেন মান্না। এই ছবিতে দুটি গান গেয়েছিলেন-- 'উপর গগন বিশাল' এবং 'দুনিয়াকে লোগো'। 'উপর গগন বিশাল' মান্না দে'কে দারুণ জনপ্রিয় করে তুলল।
১৯৫০-এর মধ্যেই মুম্বইয়ে হিন্দিছবির জগতে অনেক বিরল অর্জন থাকলেও বাংলা গানে মান্না দে বেশ কিছুটা দেরি করেই ঢুকেছিলেন। তাই বাঙালি শ্রোতার মনে কোথাও একটা ছোট্ট না-পাওয়া আজও বোধ হয় চিনচিন করে; মান্না যদি আরও কয়েক বছর আগে গাইতে আসতেন বাংলায়! তা হলে কি ১৯৫০-এর ওই বিখ্যাত 'ট্রায়ো'র জায়গায় বাংলা সঙ্গীতভুবনে রচিত হত না বাংলা গানের এক অভূতপূর্ব সোনালি চতুর্ভুজ?
আরও পড়ুন: Sandhya Mukhopadhyay: মান্না দে'র সঙ্গে গোলাপের বাগে চম্পা-চামেলি ফুটিয়েছিল সন্ধ্যা-কণ্ঠ