পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশা পূরণ, তেড়েফুঁড়ে বেরোল ইতিহাস
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম: মানঝি- দ্য মাউন্টেন ম্যান
রেটিংঃ ****1/2
এ এক মধুর প্রেমকাহিনি। দশরথ আর ফাগুনিয়ার। যে প্রেমের শপথ রাখতে সারাজীবন বাজি রাখতে পারে এক পাগল প্রেমিক। অর্ধমৃতা, অন্তঃসত্ত্বা ফাগুনিয়াকে পাহাড় পেরিয়ে বয়ে নিয়ে যেতে যেতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাঁচাতে পারেননি দশরথ। সেদিন থেকেই প্রতিজ্ঞা পাহাড় ভাঙার। প্রতিদিন একটু একটু করে পুরো পাহাড়টাই ভেঙে ফেলার, যাতে একটা রাস্তা তৈরি হতে পারে, শহরে যাওয়ার। যুগের পর যুগ ধরে, সমাজ সংসার ও রাষ্ট্রের নিন্দা, তামাশাকে প্রত্যাখ্যান করে, শুধুই লক্ষ্যে অটল থাকার। এক সত্যকাহিনি। মর্মস্পর্শী, রুদ্ধশ্বাস।
একে শুধু গল্প বললে, কিছুই বলা হয় না। সমাজের নিচতলার মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস, রাষ্ট্রশক্তির বদলের পরেও বদলে না যাওয়া সিস্টেম আদ্যোপান্ত উঠে এল পর্দায়। জমিদার প্রথার অবনমন, জাতীয় কংগ্রেসের উত্থান, সব রাজনৈতিক ইতিহাসই বেরিয়ে এল তেড়েফুঁড়ে।
বাইশ বছর ধরে বাস্তবের দশরথ পাহাড় কেটেছিলেন। হাতুড়ি, শাবল সম্বল করেই। এই সত্য কাহিনির শেষ হয়েছিল ২০০৭ সালে। বাস্তবের দশরথ মাঝি মারা গিয়েছিলেন সে বছর। তারও চার বছর বাদে সরকারি উদ্যোগে কাটা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে রাস্তা তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এত দিন অপেক্ষা করতে হল কেন, সেটা কাস্টিং দেখেই বুঝতে পারবেন। নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির মুখ আর অবয়ব এবং অভিব্যক্তি ছাড়া এ ছবি তৈরিই হত না। ইরফান খানের কথা মাথায় রেখেই বলছি। সারা ছবি জুড়ে দর্শক মন্ত্রমুগ্ধ, স্তব্ধ হয়ে থাকবেন।
পাহাড় ভাঙার বাস্তব আর প্রতীকী দুটো অর্থই পরদায় সফলভাবে ধরতে পেরেছেন পরিচালক কেতন মেহতা। কাহিনি ও ক্যামেরার সংঘবদ্ধ প্রয়াসেই প্রত্যন্ত বিহারের সেই পাহাড় হয়ে উঠছে চরিত্র। কখনও ভয়ঙ্কর, কখনও প্রতিদ্বন্দ্বী, কখনও প্রেমিকার মতো স্নিগ্ধ। যিনি মির্চ মসালা এবং রঙ রসিয়ার মতো ছবি বানিয়েছেন, তাঁর কাছ থেকে প্রত্যাশা ছিল অনেক। পূরণও হয়েছে অনেক। রাধিকা আপ্তে ও নওয়াজের প্রেমদৃশ্যের সারল্য আর সাবলীলতাকে মাটির রঙে বর্ণে ও শোভায় মিলিয়ে দিয়েছেন। রঙের উল্লাসের সঙ্গে মিশেছে আলোছায়ার খেলা।
নায়িকা রাধিকা আপ্তে-র সরল সৌন্দর্যটাও ব্যবহার করেছেন পরিচালক। দলিত মহিলাদের আদলে শাড়ি পরা, চলন বলনে এক অন্যরকম রাধিকাকে আবিষ্কার করবেন আপনারা। অন্তহীন বা রূপকথা নয়-এর চেয়ে আলাদা এক অভিনেত্রীকে পাওয়া গেল, যাঁকে কেতন মেহতার সমসাময়িক অভিজ্ঞ পরিচালকেরা ব্যবহার করবার কথা ভাবতে পারেন।
সাংবাদিক অলোক ঝা-এর ভূমিকায় গৌরব ত্রিবেদীর অভিনয়ও দাগ কাটবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ইমপ্যাক্ট ফেলবে ছবির সাউন্ড। সন্দেশ শান্তিল্যর মিউজিক ও রাজীব জৈনের ক্যামেরা। ছবি শেষ হওয়ার পরেও মনে থেকে যায় মাথায় রয়ে যায়। দ্য মাউন্টেন ম্যানের কাহিনি খননকার্য এত নিপুণভাবে সম্পন্ন করলেন যিনি, সেই কেতন মেহতার জন্য প্রশংসার সঙ্গে ধন্যবাদও রইল।