গৌরীপ্রসন্ন যেন আধুনিক বাংলা গানের কবি কিটস

তিনি না লিখলে কী ভাবে গানের ইন্দ্রধনু ছেয়ে ফেলত আমাদের মনের আকাশ!

Updated By: Dec 5, 2020, 08:06 PM IST
গৌরীপ্রসন্ন যেন আধুনিক বাংলা গানের কবি কিটস

সৌমিত্র সেন

আমরা যখন কোনও গান শুনি তখন সর্বক্ষণ সঙ্গীতশিল্পীর কৃতির কথাই আমাদের মনে ওঠে। গান ভাল লাগলে তার পরে আমরা হয়তো খুঁজি গানটির সুরকারকে! ব্যস! মোটামুটি ওখানেই আমাদের সমস্ত অনুসন্ধিৎসা শেষ হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে খুব-খুব কম শ্রোতাই থাকেন, যিনি আর একটু কষ্ট করে গানটির রচয়িতাকেও খোঁজেন। 

এই রকম একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক আবহে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের মতো গীতিকারের জন্ম-কর্ম-মৃত্যু। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। মূল্যায়ন তো দূরের কথা আমরা মনেই রাখিনি তাঁকে। 

অথচ তিনিই ছিলেন আধুনিক বাংলা ফিল্মসঙ্গীত ও ডিস্কসঙের অবিসংবাদিত সম্রাট। প্রণব রায়ের মধ্যে দিয়ে বাংলা আধুনিকে যে কবিত্বগন্ধী লিরিকের ঘনিষ্ঠ চর্চার শুরু গৌরীতে এসে তা তুঙ্গস্পর্শী। নিছক গীতিকার বললে গৌরীপ্রসন্নকে তাই ছোট করা হয়। আক্ষরিক অর্থেই তিনি কবি। আমাদের বাংলাগানের লিরিকের এক মধুর কবি।

১৯২৫ সালে ৫ ডিসেম্বর পাবনার ফরিদপুরের গোপালনগর গ্রামে জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন বিখ্যাত বটানিস্ট। কিন্তু গৌরী নিজে উদ্ভিদ নয়, মানুষের মনের ভাবরসেরই রসিক হয়ে উঠলেন! না হলে, লিখবেন কী করে! লিখলেনই-বা কী করে এতগুলি বছর ধরে?

আর তিনি গান না লিখলে কী ভাবে গানের ইন্দ্রধনু ছেয়ে ফেলত আমাদের মনের আকাশ! তিনি না লিখলে কী ভাবে সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যার বন্ধনে জড়িয়ে পড়তাম আমরা! তিনি না লিখলে মেঘলা দিনে একলা ঘরে থাকার যন্ত্রণা বোধগম্য হত কী করে আমাদের? তিনি না লিখলে আমরা কী করে জানতাম বেদনার বালুচরে ঘরবাঁধার দুরাশার কথা?

একটা সময়ের পরে রোগে ভুগে ক্ষয়ে যন্ত্রণায় গৌরী শেষ হয়ে গিয়েছেন মাত্র বাষট্টি বছর বয়সে; কিন্তু অমৃত তুলে দিয়ে গিয়েছেন শ্রোতার নিবিড় শ্রবণে। রোম্যান্সের দ্যুতি আর বিরহের ম্লানিমার ললিত সঙ্গমে গৌরীপ্রসন্ন যেন বাংলাগানের কবি কিটস। 

ছোট থেকেই শচীনকত্তার কণ্ঠ ও সুর গৌরীপ্রসন্নকে সব চেয়ে বেশি টানত। গৌরী তখন কলেজছাত্র। একটি গান লিখে নিয়ে সোজা চলে গেলেন তাঁর স্বপ্নের মানুষটির সঙ্গে দেখা করতে। যদি, সেটা সুর করেন বা গান শচীনকত্তা! শচীনকত্তা রাজি হলেন। সেই শুরু। পড়াশোনা শেষ করার পরেই তাঁর কাছে ডাক এল শচীনকত্তার। গৌরী জানলেন, শচীনকত্তার জন্য ছ'খানা গান লিখতে হবে তাঁকে! মাথায় যেন স্বর্গ চেপে বসল। যেন খুলে গেন এতদিন ধরে মনের নিভৃতে চাপা দেওয়া শব্দ-ছন্দের ঝরনাধারা। 

তার পর তো শুধুই প্রবাহের জোয়ার। হেমন্ত-মান্না-সন্ধ্যা-শ্যামলের কণ্ঠের সিংহভাগ গানের গীতিকার গৌরীই। বহু সুরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন, তবে নচিকেতা ঘোষের প্রায় সত্তর ভাগ গানের গীতিকারই তিনি। এবং শুধু গান নয়। লিখলেন 'দেয়া-নেয়া', 'সূর্যতোরণ', 'সূর্যতপা', 'শুধু একটি বছর'-এর মতো ছবির কাহিনিও!

তবে গান নিয়েই তো তাঁর অভিযাত্রা! বাণীকণ্ঠে কত-কত পথ যে হাঁটলেন। এবং এত-এত মণিমুক্তো তাঁর চলার পথের দু'ধারে ছড়িয়ে রাখলেন যে মানুষ তাঁর মর্যাদা করতেই শিখল না। আলো-বাতাসের মতো মহার্ঘ জিনিস অক্লেশে পেয়ে আমরা যেমন সেসবের যথার্থ গুরুত্ব দিই না, গৌরীর গানও আমাদের কাছে যেমন তেমনই অপরিহার্য কিন্তু কৌলীন্যহীন হয়ে রয়ে গেল!

আমরা গুনগুন করি গানটা কিন্তু ভুলে যাই যে, ২০০৪ সালে বিবিসির নিরিখে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় ঠাঁই পেয়েছিল মান্না দে'র গাওয়া গৌরীর লেখা 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা'! আমরা ভুলেই যাই যে, হেমন্তের 'মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে' গানটি গৌরী বাংলাদেশ রেডিয়োর জন্য লিখেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২-এর ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন গৌরীপ্রসন্ন। আমরা ভুলে যাই যে, গৌরীর কৈশোর-যৌবনের স্বপ্ননায়ক স্বয়ং শচীনকত্তা গৌরীকে তাঁর অতি তারুণ্যেই 'কলকাতার মজরু সুলতানপুরী' বলে চিহ্নিত করেছিলেন!  

গৌরী নিজেও জানতেন বাংলাগানের এই অপূর্ব রঙরঙিন মেহফিলে গীতিকাররা ব্রাত্যই। নিজের কৃতি সম্বন্ধে আত্মবিশ্বাস ছিল, বেদনা তো ছিলই। এক সাক্ষাৎকারে গৌরী তো বলেওছিলেন, 'কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে গীতিকারদের স্থান দেওয়া হয় না। এ বড় ক্ষোভের কথা। অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায়, মোহিনী চৌধুরী প্রমুখ গীতিকারদের কবিপ্রতিভা সম্বন্ধে কারও কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবু কবিসম্মেলনে কোনও গীতিকারকে ডাকা হয় না। কবিতায় সুর দিলেই গান হয় না। গানের ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা। তা না হলে রবীন্দ্রনাথ কবিতা ছাড়াও অত গান লিখতেন না।'

২০ অগস্ট মাত্র ৬২ বছর বয়সে চলে গিয়েছিলেন বাংলা লিরিকের রাজকুমার গৌরীপ্রসন্ন। শোনা যায়, হাসপাতালে শুয়েই নাকি লিখেছিলেন তাঁর শেষ গানটি। সে-গান মর্মছেঁড়া বাণীর কাতর নিবেদনে আজও দুখী করে বাঙালিমনকে-- 'এবার তাহলে আমি যাই, সুখে থাকো ভালো থাকো, মন থেকে এই চাই' আজও যেন গৌরীর স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত করে বাঙালির মন! 

also read:  স্মরণে 'জয়া আম্মা', জয়ললিতার মৃত্যুবার্ষিকীতে 'থালাইভি'র ছবি পোস্ট করলেন কঙ্গনা

.