মেঘের আড়ালে প্রথম আলো
শর্মিলা মাইতি ছবির নাম- মেঘে ঢাকা তারা রেটিং- ***
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম- মেঘে ঢাকা তারা
রেটিং- ***
নানা ধরণের অনুভূতি হয় একটি ছবি দেখে হল থেকে বেরনোর পর। ফুরফুরে, হতাশ, বেদনা কিংবা নেহাতই বিরক্তি। এ ছবি দেখে বেরনোর পর মন আর হৃদয়ে কী যেন একটা অবশ করে দেয় ইন্দ্রিয়ানুভূতিকে। কীসে যে এত ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে মন, তার হদিশ পাওয়া যায় না। অন্তত পরবর্তী দু`তিনদিনের জন্য।
ঋত্বিক ঘটক ইন্টেলেকচুয়াল-খ্যাত বুদ্ধিজীবী বাঙালির কাছে একটি নাম, যা সময় ও সুযোগবিশেষে ড্রপ করা যায়। সত্যজিত্ রায়কে যেমন হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায় কখনও কখনও, ঋত্বিককে তেমন নয়। ফিল্ম স্কুল, সেমিনার, আন্তর্জাতিক সিনেমা বৈঠক- এ সবে যে ঋত্বিক-খননকার্য হয়, জনশ্রুতি অনুসারে তা নাকি সাধারণ দর্শকের বোধের বাইরে। তবুও ঋত্বিক-জীবনী নিয়ে জনমানসে ঔত্সুক্য কিছু কম নয়। কিন্তু কীভাবে বলা যায় একটি জীবনকাহিনি, যা আসলে প্রচুর তত্ত্বের মেঘ দিয়ে ঢাকা? জন্মদিন ও মৃত্যুদিনের মাছখানের সময়টা নিয়ে, ইতিহাস ও কল্পনা মিশিয়েই কি তৈরী হতে পারত একটি জীবনছবি?
নবীন পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় প্রথমেই ঋত্বিককে ছুঁলেন ডাক্তারের চোখ দিয়ে। অপারেশন টেবিলে। গল্প-বলি-গল্প-শোনো কাঠামোটাকে একেবারে ভেঙেচুরে দিয়ে নতুন জীবনীসৌধ নির্মাণ করতে শুরু করলেন। টাইম-স্পেসের যে লম্বা চওড়া রচনাগুলো পড়তে হয় ফিল্ম স্কুলের লাইব্রেরিতে বসে, সেগুলির বাঁধনও ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন কখন। একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল সময়ের গতি, ফ্ল্যাশব্যাক-ফ্ল্যাশফরোয়ার্ড, ফেড-ইন-ফেড-আউটের চলতি নিয়মনীতি। একটা অন্য ঋত্বিকদুনিয়া, যেখানে শুধু সজাগ থাকবে ইন্দ্রিয়। এই বিশেষ ভঙ্গিমায় জীবন-কথন একেবারে মৌলিক কি না, সে যুক্তি-তর্কে না গিয়ে এটাই বলা চলে, ঋত্বিক ঘটকের পাঠযোগ্য জীবনী বানানোর জন্য এ ছবি নির্মাণ করেননি তিনি। পরিচালকের চেয়ে বেশি খননশিল্পী তিনি, খুঁড়ে চললেন ঋত্বিকের দেহাবয়ব। মস্তিষ্ক থেকে শ্বাসনালী, অস্থি, মদিরাসিক্ত খাদ্যযন্ত্র। ব্যবচ্ছেদের ছবি। যে-ছবি আমরা পর্দায় দেখলাম, তাতে ফুটে উঠল এক রূপকময়তা। ঋত্বিকের চোখ যা দেখতে পাচ্ছে, তা-ই আমরা দেখছি। যেদিকে যাচ্ছেন, দর্শকও সেই দিকেই চলেছেন। সালভাদর দালির ঘড়ি মাড়িয়েও যখন এগিয়ে গেলেন ঋত্বিক ও ডাক্তার, তখনও দর্শক সমান সম্মোহিত। সবখানেই ছড়িয়ে আছেন ঋত্বিক ঘটক তবু কী সাংঘাতিক মাধ্যাকর্ষণ, সব সময়েই ঋত্বিকের অন্তরমহলের অতলে টানছে দর্শককে।
কোনও নামই বাস্তব নাম নয়। পৌরাণিক। পুরাণ ও বাস্তবের এমন সমন্বয় আধুনিককালের কোনও এক্সপেরিমেন্টাল ছবিতে দেখা যায়নি। এতক্ষণ যে-চরিত্রকে নীলকণ্ঠ বলছি, তিনিই ঋত্বিক। দেশভাগের যন্ত্রণা, হাহাকার আর বঞ্চনার বিষ যিনি স্বকণ্ঠে ধারণ করেন। তাঁর স্ত্রী সুরমা ঘটকের চরিত্রের নাম দুর্গা। অন্নপূর্ণা। যে-কোনও সঙ্গতিতেই অন্নের অভাব পূরণ করে সংসার-প্রতিপালন করেন। শাশ্বত ও অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। মহাদেব-দুর্গার এই সহাবস্থান পুরাণই মনে পড়ায়, দুঃখ-শোক-মায়ার ঊর্ধ্বে গিয়ে। তেমনিভাবেই তাঁদের ঘিরে সব চরিত্র কাল্পনিক হয়ে ওঠে। সব নামই বদলে যায়। নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য হয়ে যান বিক্রমদা। এ চরিত্রে শুভাশিস মুখোপাধ্যায়। বদলে চলে সিনেমার নামও, শুধু রেফারেন্স পয়েন্ট থাকে ঋত্বিক ঘটক। মেঘে ঢাকা তারা হয়ে যায় মেঘের আড়ালে। আমরা দেখলাম অনিল চ্যাটার্জির জায়গায় রাহুলকে। সেই বিখ্যাত সঙ্গীত, লাগে লগন পতিত পাবন.. বদলে গেল অন্য সুরে, তবু স্মৃতি দোরের কড়া নড়ল। বাড়ি থেকে পালিয়ে হয়ে গেল ঘরছাড়া। সুবর্ণরেখা বদলে গেল সোনার নদীতে। কিন্তু বদলালো না ছিন্নমূল হওয়ার যন্ত্রণা, পার্টিশানের অপূরণীয় ক্ষতি, একের পর এক হতাশার কাহিনি বুকে চেপে রাখার যন্ত্রণা। ঋত্বিকের এই কল্পলোকে এইসব চরিত্রের সঙ্গে বার বার দেখা হতে থাকল। বাস্তব আর কল্পনা একাকার হয়ে যাওয়ার এক ম্যাজিক রিয়্যালিজম। জীবন হল নাট্যমঞ্চ। তাঁর শেষযাত্রার ছবি তোলপাড় তোলে মনে। ঠোঁটে মুড়ে ধরা টাকা, তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্ত্রী ও ছেলে। তবুও ঋত্বিক মরে ফুটপাথে, জানতে পারে না লোকে!
প্রশ্ন উঠতেই পারে, এত নাটক কেন? ঋত্বিক তো সিনেমা বেশি, নাটক কম। গোটা জীবনটাকে মেলে ধরার জন্যই পরিচালক নাটকের ফর্মটা ব্যবহার করলেন সম্ভবত। এমন গভীর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা শুধুই প্রপস, আলো আর ক্যামেরার কারিকুরি দিয়ে সম্ভব, এতটা ভাবাই যায়নি। আর শিউরে উঠে দেখলাম, যে পথ ধরে হেঁটে চলেছেন নীলকণ্ঠ ঋত্বিক, সে পথ কী কঠিন। গুলিবিদ্ধ বিপ্লবী, গর্ভবতীর দেহ, ধর্ষিতার দেহ সেই পথেই ছড়িয়ে আছে, লুটিয়ে পড়ছে। ভিখিরির মতো আসা স্বাধীনতার মূল্য দিয়েছে যারা দেহ দিয়ে।
এরই মাঝে মাঝে আয়নায় ভেসে ওঠে নবীন তরুণ নীলকণ্ঠের ছবি। যৌবনের বিশ্বাস, রাজনৈতিক অবস্থান, সাহিত্যিক সতীর্থেরা। প্রেম ও পরিণয়। কাপালিকের ভূমিকায় মঞ্চে অবতীর্ণ যুবক ঋত্বিক। নাটক ও সমাজের প্রতি ডেডিকেটেড একটি সত্তা। সুপ্রিয়ার চরিত্রে মুমতাজও বেশ সপ্রতিভ। তাঁর অভিনয়ও মন ছুঁয়ে যায়।
ঋত্বিকের ডাক্তারবাবু, যে-চরিত্রে অভিনয় করেছেন আবির চট্টোপাধ্যায়, সে পরিচালকেরই চোখ। ঋত্বিক বা নীলকণ্ঠের শরীর মনের ভার যার হাতে ন্যস্ত। উন্মত্ততার বাড়াবাড়ি হলেই ইলেকট্রিক শক। খুব মর্মস্পর্শী সেই সব দৃশ্য, কলম দিয়ে বর্ণনা করবার নয় কারণ, শারীরিক যন্ত্রণাও ঋত্বিকের মনের পৃথিবীতে নতুন স্মৃতির সঞ্চার করে, মূলত ছেলেবেলার। এখানেও বাস্তব আর কল্পনার চরিত্র একসঙ্গে হেসেখেলে বেড়ায়। নিজের জীবনের নানা অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছিলেন ছবিতে, তাদের সঙ্গেই বোঝাপড়া আর কথোপকথন চলতে থাকে। ভাঙনের শেষ মুহূর্তে এসে অযান্ত্রিক ছবির গাড়িটির সঙ্গেও বার বার দেখা হয় তার।
টাইম আর স্পেসের ধারনা একেবারে বদলে দিলেও ইতিহাস বলতে গিয়ে কোথাও হোঁচট খাননি। ঋত্বিক যখন একের পর এক ছিন্নমূল মানুষের গভীর মনস্তত্ত্ব তুলে আনছিলেন, ঠিক সেই সময়েই হিট হয় উত্তম-সুপ্রিয়া অভিনীত ছবি মন নিয়ে। উত্তম-বাণিজ্যিক ছবির কাছে অন্য ধারার ছবির হেরে-যাওয়ার ছবি। মনের অনেকগুলো দরজা একসঙ্গে খুলতে গেলে প্রথমেই একটা দমকা হাওয়া আসে, কিছুই ঠাহর করা যায় না। তবু নীলকণ্ঠ যে আশা করেছিলেন, টাকা থাকবে না, কাজ থেকে যাবে। সেটাই রয়ে গেল কাল্ট ছবি হয়ে, ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়ে।
শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এমনই এক বিস্ময়বালক যে তাঁর কোনও কাজকে সেরা কাজ বলতে কলম কাঁপে। মনে হয় পরের ছবিটাতেই তিনি এ-সব প্রশংসা মুটমুট করে ভেঙে ফেলে নতুন কোনও তাক লাগাবেন। অনন্যা কী অপূর্ব শান্ত ও সংযত। এই অভিনয় করার মতো কেউ একজনও নেই এই টলিউডে, সংক্ষেপে এটুকুই বলা যায়। হার্বার্ট-এর পরে আবারও একবার ঘুম কেড়ে নিলেন শুভাশিস। সচরাচর এরকম অভিনয়ের দেখা আমরা পাই না এঁর থেকে। অতি সন্তর্পণে তিনি লুকিয়ে রাখেন এই সৃজনশীল শিল্পীকে, মনের গভীরে। আবির বড় বেশি হ্যান্ডসাম, বিলেতফেরত ডাক্তারের চেহারায় মিলে যায় যদিও।
এতদসত্ত্বেও বড় ভারাক্রান্ত লাগে। ঋত্বিক-মনস্তত্ত্বকে দর্শকমনে সিরিঞ্জ দিয়ে প্রবেশ করিয়ে দেওয়ার জন্য। এখনও যাঁরা ‘সারা পৃথিবীর ছবি’র সঙ্গে তেমন পরিচিত নন, তাঁরা থই পাননি বলেই মনে হল। অনেকগুলো জানালা একসঙ্গে খুলে গেলে যে-অনুভূতিটা হয়। মেঘে ঢাকা তারা মোটেও সহজপাঠ নয়, সহজবোধ্যও নয়। বিপন্নতা, একাকিত্ব, যন্ত্রণার অন্য এক বর্ণপরিচয়। তবুও বাহবা, একটি গোটা ছবিকে রূপক হিসেবে বলতে পারার ক্ষমতা ধরার জন্য।