বেরিয়ে এল সত্য ইতিহাস বলার ধৃষ্টতা
ছবির নাম-ম্যাড্রাস ক্যাফে রেটিং- ****
শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম-ম্যাড্রাস ক্যাফে
রেটিং- ****
তখনও জানা ছিল না, হিউম্যান বম্ব কী, কাকে বলে সুইসাইড বম্বার। সবার বাড়ি টিভি আসেনি তখনও, পড়াশোনা চুলোয় যাওয়ার আশঙ্কায়। পরীক্ষার সময়ে আলমারির ওপরে দরজা বন্ধ করে তোলা থাকত টিভি। আর সকাল শুরু হত আকাশবাণী দিয়ে। সেই আকাশবাণীই একদিন শোনাল.. অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী গতকাল নিহত হয়েছেন....এক ভদ্রমহিলা তাঁকে মাল্যদান করতে এসেছিলেন, তাঁর দেহ সম্পূর্ণ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে। আর দেখেছিলাম, বাবা-মায়ের চোখে জল। পাড়া-প্রতিবেশীর চোখেমুখে বিষণ্ণতা। আপনজন বিয়োগের দুঃখ যেন সবখানে ছড়িয়ে আছে। তখনও জানা ছিল না, সুইসাইড বম্বার কাকে বলে.. মৃত্যু যে এক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হতে পারে, তখন শুধুই ইতিহাসের পাতার অনুভূতিরহিত শব্দসম্ভারেই সীমাবদ্ধ থাকত। দক্ষিণভারত থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকার প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর মৃতদেহের সেই বিতর্কিত ছবি। সেই স্মৃতিও একদিন ঢাকা পড়ে গেল নাইন ইলেভেন, আরও কত কী দিয়ে।
সেই স্মৃতি উসকে তোলার জন্য ধন্যবাদ দেওয়া যায় নাকি দোষারোপ করা যায় পরিচালক সুজিত সরকারকে? অত্যন্ত চেনা একটি গল্প বলার ধরনকে আশ্রয় করে এমন একটি অবিশ্বাস্য বিশ্বাসযোগ্য গতিময় ছবি তৈরি করা সম্ভব, সেটা দেখালেন তিনি। যুদ্ধ, রক্তক্ষয়, বিশ্বাসঘাতকতার এই আখ্যানে কোথাও আটকে যাওয়া নেই। ভারতীয় ছবিকে এক কথায় তিনি একটি রুদ্ধশ্বাস অ্যাসাসিনেশন ফিল্ম উপহার দিলেন।
রাজনৈতিক নেতার অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা যে-কোনও দেশের ছবিনির্মাতার কাছেই একটি প্রলোভন। দর্শকের স্বাভাবিক ঔত্সুক্য, ভয়ারিজম দুটোই প্রবল অনুঘটকের কাজ করে। জেএফকে থেকে দ্য ডে অফ জ্যাকল, সব ছবিতেই এই কৌতূহল নিয়ে ছবির গল্প বানানোর কায়দাটা প্রতিবারই চূড়ান্ত সফল। ভারত-শ্রীলঙ্কা দ্বন্দ্ব নিয়ে যে কাহিনি সুজিত বলেছেন, তাতে কিন্তু কোনও সফল মডেলের ছায়া পাওয়া গেল না। বরং বেরিয়ে এল একটি সত্য ইতিহাস বলার ধৃষ্টতা। যে কাল্পনিক চরিত্রগুলো দিয়ে তিনি একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ব্যবচ্ছেদ করলেন, সেগুলোও কেমন মারাত্মক সত্য। যেন প্রতিটি শব্দ লেখার আগে মনে রেখেছিলেন, এ কাহিনি জানানো তাঁর নাগরিক দায়িত্ব। নামবিচ্যুতি অবশ্যম্ভাবী ছিল। এলটিটিই হয়েছে এলটিএফ (লিবারেশন অফ তামিল ফেডারেশন), নাম বদলে হয়েছেন আন্না প্রভাকরণ, প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন প্রাক্তন, তবু কাহিনি বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না কোথাও।
জন এব্রাহাম এখানে রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং-এর সদস্য। দুই দেশের শান্তিচুক্তির মধ্যেই লীন হয়ে আছে চক্রান্ত। গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার গন্ধ পেয়ে অনুসন্ধান শুরু করে সে। গোটা গল্পটা বলা নিষ্প্রয়োজন কারণ, অতীব জটিল এক চক্রান্তের কেমন একের পর এক রুদ্ধশ্বাস মোড়ক খুলছে, সেটাই ম্যাড্রাস ক্যাফে-র ইউএসপি। ইন্টারভ্যাল আসে শুধু টয়লেট ব্রেক হিসেবে। কোথাও দাঁড়ি টানার ফুরসত দেননি স্ক্রিপ্টরাইটার। জনের পাশে নার্গিস ফকরির কম্বিনেশন নিয়ে নানা মুনির নানা মত ছিল। কিন্তু এ ছবি দেখলে সে ভুলই ভেঙে যাবে। যে কম্বিনেশনটা হতে পারে না, সেটার মধ্যেই একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক দেখানো যায় রুপোলি পর্দায়। বিদেশী ওয়র জার্নালিস্ট হিসেবে নার্গিস ফকরি একেবারে স্বচ্ছন্দ, স্বাভাবিক। নিখুঁত অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলেছেন। পোশাক-আসাকেও সাবলীল। অন্নার সঙ্গে ইন্টারভিউএর দৃশ্যও মিস করার নয়।
কখনও হেলিকপ্টার শট, কখনও ক্রেন শট, কখনও এক্সট্রিম ক্লোজ-আপ আর লং শট। ক্যামেরা এ ছবিতে যেন এক যুদ্ধপ্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত। যুদ্ধ দৃশ্যের এমন মর্মান্তিক পরিণতি, মৃতবত্ জীবিত নিরপরাধের ঢল, সব দৃশ্যই মানুষকে ভাবাবে। সে রাজনীতিবিদ হোক, বা সাধারণ নাগরিক। আসি ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে। বহুবার অভ্যাস করার পর, সম্ভবত বিশ্বের প্রথম হিউম্যান বম্বার, স্থিরচোখে মুখে স্মিত হাসি রেখে সেই মানবী ফুলমালা বাড়িয়ে দিচ্ছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর উদ্যেশ্য। তার পরেই প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ। যাঁদের হার্টের অসুখ নেই, তাঁরাও বেশ কয়েকটা বিট মিস করতে পারেন! এ ছবির নাম কেন জাফনা নয়, কেন ম্যাড্রাস ক্যাফে, সেটাই আসলে চক্রান্তের একটা ক্লু। এটুকুই জানানো যেতে পারে। ভুলে যাই এ ছবিতে কোনও গান ছিল না। মনে পড়ে শেষ হওয়ার পরে। ছিল না একটিও আইটেম সং। তবুও উত্তেজনায় প্রায় নির্বাক হয়ে যান দর্শক। ছবির শেষে গান শুরু হলে যেন ধাতস্থ হই একটু। নেমে আসি সমতলে।
তবে একটিই খুঁত চোখে পড়ে। চার্চের ফাদারের সঙ্গে কথোপকথনের দৃশ্যের আরও অনুশীলন প্রয়োজন ছিল। আরও একটু ভাল অভিনয়। যদিও গোটা ছবির গায়ে কাঁটা-দেওয়া অনুভূতির কাছে সেটুকু নেহাতই নগণ্য।