রোদন-হরষে ভরা বসন্তের লিপি
হৃদয়কে যদি ধরা হয় একসঙ্গে বাঁধা তন্ত্রীর সমন্বয়, তবে সঠিক সুর তোলার জন্য হাত বুলিয়ে ঠিক তারটি খুঁজে বের করে টান দিতে হয়। এই সন্ধানকার্যে অল্প সময় লাগতে বাধ্য। বসন্ত উত্সবে নানা রঙের আবির-মেঘের ফাঁকফোঁকর দিয়ে এক ঝাঁক রঙিন চরিত্র বের করে এনেছেন পরিচালক।
শর্মিলা মাইতি ছবির নাম: বসন্ত উত্সব
রেটিং: ***
হৃদয়কে যদি ধরা হয় একসঙ্গে বাঁধা তন্ত্রীর সমন্বয়, তবে সঠিক সুর তোলার জন্য হাত বুলিয়ে ঠিক তারটি খুঁজে বের করে টান দিতে হয়। এই সন্ধানকার্যে অল্প সময় লাগতে বাধ্য। বসন্ত উত্সবে নানা রঙের আবির-মেঘের ফাঁকফোঁকর দিয়ে এক ঝাঁক রঙিন চরিত্র বের করে এনেছেন পরিচালক। এমন ছবি দেখার প্রথম শর্ত হল ধৈর্য। একটু অপেক্ষা করতে পারলে তবেই বসন্তের রঙিন আবির হৃদয় ছোঁবেই। আবেগের তন্ত্রীতে শেষ মুহূর্তে টান দিতে পেরেছেন তিনি।
চরিত্ররা দোষে-গুণে মেশানো নানা রঙের মানুষ। সবাই দোল উত্সবের মরশুমে এসে উপস্থিত হয়েছেন শান্তিনিকেতনে। প্রত্যেকেই রঙের সঙ্গে রঙ মেলাতেই এসেছেন, তবু সবার বাসনার রং আলাদা আলাদা। কেউ এসেছেন, শেষের সেদিনটি শান্তিনিকেতনেই কাটিয়ে যেতে। কেউ বা এসেছেন দমবন্ধ জীবন থেকে বেরিয়ে একমুঠো শ্বাস নিতে...পাঁচটি আলাদা আলাদা কাহিনি জুড়ে যায় একই গ্রন্থিতে। এক প্রবাসী প্রৌঢার সঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের আলাপচারণ। কলকাতার এসকর্ট-সার্ভিসে যুক্ত তরুণী ও কলাভবনের ছাত্র। সাহিত্যের অধ্যাপক, তাঁর স্ত্রী, এক প্রেমিকা ছাত্রী, এক অসামাজিক ক্রিয়াকলাপে যুক্ত যুবক, যে তার বিবাহিতা প্রেমিকার খুনির শাস্তি চাইছে। এক সাংবাদিক যিনি বছরের পর বছর আসেন এই উত্সব কভার করতে।
প্রথমার্ধ বেশ শিথিল। চিত্রনাট্য শুধুই চরিত্রগুলো বুড়ি-ছুঁয়ে বেরিয়ে যায়। অযথা সময়ের অপব্যবহারের নিদর্শন প্রচুর। অধ্যাপক-স্ত্রী-প্রেমিকা ছাত্রী ত্রিকোণ নিয়ে অনর্থক বকবকানি প্রায় হাই-তোলা পর্যায়ে চলে যায়। শহুরে তরুণী ও কলাভবনের ছাত্রের আলাপ থেকে প্রেম পর্যায়ে উত্তীর্ণ হওয়ার আলাপচারিতাও তেমন হৃদয়গ্রাহী নয়। খঞ্জ অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির অ্যাকটিভিটিও বোঝা যায় না। সাংবাদিকের চরিত্রে ঋতব্রত ভট্টাচার্যকেও ম্লান মনে হয় অতিকথনের দোষে। খুবই খাপছাড়া এলোমেলো কয়েক জোট চরিত্র। চায়ের দোকানে ভাল চা খায়, কখনও কখনও দার্জিলিং চায়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করে। বেশ কিছুটা সময় রিপিটিটিভও বটে। শান্তিনিকেতনের গৌরচন্দ্রিকা করতে করতেই এত সময় নিয়ে ফেলেছেন যে সত্যিসত্যিই আলস্য আসে। এইরকম একটা সময়েই ইন্টারভ্যাল, প্রায় হতাশ করেই ব্রেক কষে।
দ্বিতীয়ার্ধ না দেখলে পুরো ছবিটাই আসলে মিস করবেন. ডেবিউ পরিচালক ঋতব্রতর সবচেয়ে বড় সাফল্য এটাই। দ্বিতীয়ার্ধে তিনি তিরের বেগে ঢুকে পড়েছেন গল্পে আর চরিত্রগুলোয়। দ্রুতগতিতে বাঁক মোড় নিয়েছে গল্প। বসন্ত উত্সবের রং-এর মধ্যে মিশে গিয়েছে একটি খুনের লাল রক্ত, এক বৃদ্ধার মৃত্যুর কালো রং, এক তরুণীর বিবর্ণ জীবনে এসেছে প্রেমের প্রথম প্রতিশ্রুতি। প্রতিটি আবেগ আর অনুভূতি যেন আবিরের বিভিন্ন রঙেরই প্রতিস্থাপক। প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে প্রতিটি কস্টিউমও। অত্যন্ত ধৈর্যের পরিচয় দেয় মৃন্ময় নন্দীর ক্যামেরাও। অতি সন্তর্পণে চলতে থাকে মানুষগুলোর পেছন পেছন। উত্সবের আনন্দের পেছনের ম্লান, সমস্যাসঙ্কুল কিংবা মৃত্যুমুখী মুখগুলো সাংবাদিকও দেখাতে পারেন না চ্যানেলে। কারণ বসন্ত উত্সবের রাইটস কেনা আছে চ্যানেলে। হাসি, আনন্দ, নৃত্যগীতের ফোয়ারা কেনা হয়েছে টাকার বিনিময়ে। বিষণ্ণতার কোনও স্থান নেই সেখানে। বৃদ্ধার চরিত্রে লাবণি সরকার যে-অভিনয়টা করলেন, তর্কাতীতভাবে শ্রেষ্ঠ। অপূর্ব অভিনয় করেছেন অরুণিমা, পীযুষ প্রত্যেকেই। মূলত, অভিনয়ের কাঠামোই কাহিনিকে একটা তৃতীয় মাত্রা দেয়। দেবজ্যোতি মিশ্রের মিউজিক দোলের আবিরের মতোই স্বচ্ছন্দ, রঙিন, মাদকতাময়। এমনই মনের ভেতরে
গুনগুন করে, যেন মনেই হয় না ক্যামেরার পর্দায় হচ্ছে। ভাল লাগে সোমলতা আচার্য চৌধুরীর গানটিও- আজ যেমন করে গাইছে আকাশ। বিশেষ করে, সাংবাদিকের স্টাইলে শেয করার টেকনিকটা- ক্যামেরায় মৃণ্ময় নন্দীর সঙ্গে ঋতব্রত ভট্টাচার্যর রিপোর্ট... আপনা থেকেই দর্শক বলে ওঠেন, বাঃ!
নতুন পরিচালক হিসেবে ঋতব্রত যতটা নম্বর পাবেন, অ্যাক্টর হিসেবে ততটা নয়। ওই দিকটা আরও ঘষামাজা করতেই হবে। দোলের আবির যেমন নানারকম রং নিয়ে আসে, ছবির শেযে চরিত্রগুলোর উত্তরণও দর্শককে নিয়ে যায় অনুভূতি আর বিশ্লেষণের অন্য জগতে। মনে থেকে যায় তাদের রঙিন হয়ে ওঠা মনগুলো।