বছরের সেরা রোম্যান্টিক জুটি শাশ্বত-রজতাভ

শর্মিলা মাইতি ছবির নাম- আশ্চর্য প্রদীপ রেটিং- ***

Updated By: Nov 22, 2013, 04:22 PM IST

শর্মিলা মাইতি
ছবির নাম- আশ্চর্য প্রদীপ
রেটিং- ***

আমাদের বোধের মধ্যেই বাস করে অনন্ত এক আরব্য উপন্যাস। হাজার এক রজনী পেরিয়েও ফুরোতে চায় না। সাধ্যের মধ্যে সাধপূরণের বাস্তবতার বিরোধীপক্ষ সে। মধ্যবিত্তের স্বপ্নের এসকালেটর। ক্রমাগত উঠেই চলেছে চাহিদার ধাপগুলো। কোথাও থামা নেই। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যখন লিখেছিলেন সেই ছোটগল্পটি, তখনকার মধ্যবিত্তের সাধ-আহ্লাদ স্বপ্ন যে দরে কেনা-বেচা হত, গ্লোবালাইজেশনের তুঙ্গস্পর্শ করবার পর আজকে তার গতিপ্রকৃতি বদলায়নি একটুও। কাজেই ভূতের ভবিষ্যত্‍-এর পর এবার বাঙালী মধ্যবিত্তের ভবিষ্যত্দর্শন নিয়ে যে অসাধারণ ছবিটা বানালেন অনীক দত্ত, দর্শকের আসনগুলোও যেন মুহূর্তে উড়ে গেল স্বপ্নের দুনিয়ায়। আশ্চর্য আসন হয়ে।

ভূতের ভবিষ্যতের পরে এত ভাল সংলাপ ও চিত্রনাট্যের জন্য আরেকবার অনীক দত্ত পর্ষন্তই অপেক্ষা করতে হল। মাঝে আর কোনও পরিচালকই এত ভাল স্ক্রিপ্ট লিখতে পারেননি। এমন নিখুঁত যে, আলপিন পর্যন্ত ফোটানোর জায়গা নেই। শেষবার বাংলা ছবির ইতিহাসে এমন সংলাপ পাওয়া গিয়েছিল হীরক রাজার দেশেতে। কিংবদন্তির সৃষ্টির সঙ্গে তুলনাটা নেহাত ধৃষ্টতা নয়, বাস্তবিকই চিত্রনাট্যকার এমন টানটান করে তার বেঁধেছেন যে ক্রেসেন্ডো আর ডিমিউনেন্ডো, কোথাও সুর নড়ছে না। ছন্দ মিলিয়ে তাথৈ-তাথৈ করে এগোচ্ছে স্ক্রিপ্ট। নাম্বার টু, শিল্পীচয়ন। গোটা বাংলার সেরা কমেডি অভিনেতারা একত্র হয়ে আইসক্রিম হয়ে গলে গেলেন যেন! সেই ভূতের ভবিষ্যত্‍ টিম। শাশ্বত-রজতাভ-খরাজ-মির-সুমিত সমাদ্দার। শুরুতেই পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় আর মনোজ মিত্রের কথোপকথন মিস করবেন না। কান খাড়া করে শুনলেই বুঝতে পারবেন, বাঙালির সেই ‘পেশন’ আর ‘নাচারাল’ ব্যাপারটা কেমন অতল গহ্বরে চলে যাচ্ছে, আর শনশন শব্দ করে উঠে আসছে প্রোমোটারির ভুঁইফোঁড় বড়লোকি স্বপ্নটা। যে স্বপ্নটার যাত্রাপথের শব্দটা আপনি ছবির শেষ পর্যন্ত শুনতে পাবেন।
আর একটা মজা অবশ্যই আছে। পরিচালকের টেনশন তৈরির দক্ষতা। প্রথম সাত মিনিটের মাথায় নামভূমিকায় "অভিনেতা আশ্চর্য প্রদীপ" রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত। কিন্তু তার কেরামতি শুরু হল ইন্টারভ্যালের দশ মিনিট আগে। এতক্ষণ ধরে তিনি সময় নিলেন মধ্যবিত্ত আলাদিনের দিনলিপির চিত্রটা আঁকতে। কনট্রাসেপটিভ কম্পানির সেলসম্যান, অ্যাসিডিটি-ডায়বেটিসে ভোগা ভেতো বাঙালি এই আলাদিন। বসের ভয়ে গুটিয়ে থাকা, বউয়ের ধ্যাঁতানিতে সেঁধিয়ে যাওয়া, বলিউডের বাঙালিনী সেক্স সিম্বলকে আপন করার স্বপ্ন লালন করা একটি মাথায়-বহরে ছোট বাঙালি। এমন একটি গতানুগতিক জীবন যেখানে নিতান্ত মিরাকল না হলে, মানে আশ্চর্য প্রদীপ জাতীয় কিছু না এলে, পরিবর্তন অসম্ভব। করাপশন বলতে মাঝেসাঝে গন্ডির বাইরে গিয়ে একটুআধটু কমিশন খাওয়া। ইন্টারভ্যাল পর্যন্ত নন-স্টপ হাসির খোরাক।

আলাদিন-জিন বন্ডিংটার আধুনিক প্রেজেন্টেশন শাশ্বত-রজতাভ জুটি। অনিলদা ও প্রদীপ দত্ত। গল্পের মতোই প্রদীপের দৈত্য শ্রুতিবিভ্রমে হয়ে যায় প্রদীপ দত্ত। মধ্যবিত্তের পেটের ইচ্ছে মুখে আসতে না আসতেই প্রদীপের জিন সামনে এনে ধরে সেইটি। ব্ল্যাকবেরি থেকে লিমুজিন থেকে ঝাঁ-চকচকে অফিস হয়ে বাইশ তলার ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট। যা চাই, মুখ থেকে খসলেই পাই। একেবারে হাইটের প্রদীপের দৈত্য। দর্শক ঘায়েল প্রদীপ দত্তের অনুগত দৃষ্টিতে। এত তীক্ষ্ণ তীব্র সম্মোহনী দৃষ্টি আর আকর্ণবিস্তৃত হাসি! অভিনয়ের গুণ-এ এই দুই শিল্পী যেভাবে আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেললেন তাতে, এবছরের সেরা রোম্যান্টিক জুটি হিসেবে শাশ্বত-রজতাভ একাধিক পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা প্রবল! এই জুটির কথোপকথন শুনতে শুনতে হাসতে হাসতেই দর্শক বেশ কয়েকটা দরজা পার হয়ে যায়। স্বপ্নিল উত্তরণের সমান্তরালেই দুঃস্বপ্নের অবনমন। নামতে নামতে এই সমাজ থামছে কোথায়? ছবির সংলাপের বিটউইন দ্য লাইনস যে বিরাট মাপের সোশ্যাল স্যাটায়ারটা চলছে, সেই গল্পটাও শোনা হয়ে যায়। প্রদীপ দত্ত এক মাল্টিডায়মেনশনাল কোম্পানির মালিক, যার নাম ম্যাজিক ল্যাম্প ইন্টারন্যাশনাল। রিয়্যালটি এসটেট, ব্যাঙ্কিং থেকে বিপিও, সবকিছুই এক ছাদের তলায়। মনে পড়ায় কি চিট ফান্ডের প্রলোভন? ব্যাঙের ছাতার মতো গ়জিয়ে ওঠা সেই সব কোম্পানি যারা চাল আলু কলা মুলো থেকে মানিমার্কেটিং পর্যন্ত সবকিছুর ব্যবসা করে রাতারাতি বড়লোক। আরও চমকে যাই এ ছবির প্রযোজক সংস্থার নামটি দেখেও! কথায় কথায় জানা যায় যে, এই আশ্চর্য প্রদীপের যাত্রাপথের কথা। ইয়োরোপ ঘুরে চায়না হয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ। চাহিদা ও ভাগ্য অনুসারে মনিব নির্বাচন। এই তথ্যও কি কথা বলে না? বলে এক আশ্চর্য বিশ্বাসে আচ্ছন্ন তৃতীয় বিশ্বের কথা।
মনে থাকবে এ ছবির গানও। রাজা নারায়ণ দেবের সঙ্গীত পরিচালনা আরও একবার তিরের ফলা হয়ে লক্ষ্যভেদ করল। সুদর্শনের কোরিয়োগ্রাফি আর এডিটরের কাঁচি দুটি অনবদ্য গান উপহার দিয়েছে। মনে থাকবে অমিতকুমারের কণ্ঠে কিশোরের সেই বিখ্যাত গানের প্যারডিও।

ছোট্ট পরিসরে অসাধারণ কমিক টাইমিং মুমতাজেরও। চরিত্রের নাম মালা মাল। বিশ্বায়নের খোলা বাজারে এর চেয়ে উপযুক্ত নামকরণ আর কীই বা হতে পারে! জনান্তিকে বলে রাখি, বিপাশা বসু কিন্তু এ ছবি দেখলে বেজায় চটবেন, যদি মানেটা ঠিকঠাক বুঝতে পারেন! শরীরী আবেদনে যে-কোনও প্রথম সারির বলিউড অভিনেত্রীর সমকক্ষ অধুনা টলিউডের একমাত্র মুখ। শ্রীলেখা মিত্রও বুঝিয়ে দিলেন এখনও তিনি আশ্চর্যভাবে অনাবিষ্কৃত।
শুরুতেই যে কথাটা বলেছিলাম, এই স্বপ্নের থামা নেই। বড়দের রূপকথায় আশ্চর্য প্রদীপের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া বড়ই কঠিন। সেই রাশটাই কখন টেনে থামিয়ে দিলেন পরিচালক নিজে। এভারেস্টের চুড়ো স্পর্শ করার আগেই ঘ্যাঁচ করে মুন্ডু নামিয়ে দিলেন যেন। ক্লাইম্যাক্সের পরেই কেন অহেতুক প্যারডি গান গেয়ে চলে গল্পের আলাদিন অনিলদা? কেনই বা এক বঙ্গবাসী কলেজের বাংলা এম-এ পাশ চরিত্র এন্ট্রি নিল, কেনই বা সে আউড়ে গেল বহুশ্রুত এক শিশুপাঠ্য, আবৃত্তি কম্পিটিশনের হট ফেভারিট একটি কবিতা? আরও একটু সচেতন হওয়া যেত টাইটেল কার্ডের ক্যালিগ্রাফির ব্যাপারে। গ্রাফিক্সের কাজও আর একটু ভাবনাচিন্তার অবকাশ রাখে। শেষটুকু দেখে বেরিয়ে মোবাইলে ফোন করে পরিচালককে ধরে একটা বিস্তারিত ফুটনোট নিলাম-শেষটা এমন কেন? কিন্তু দর্শকের তো সে সুযোগ নেই, কাজেই শেষবেলায় একটু খুঁতখুঁতুনি নিয়েই হল থেকে বেরোতে হল যে!
বিশেষ দ্রষ্টব্য: বাচ্চারা ক্রিকেট খেলতে খেলতে বলটা গাড়ির তলায় গড়িয়ে চলে গেলে একটু কষ্ট করে নিচু হয়ে কুড়িয়ে দিন। গাড়ির তলাটা ভাল করে দেখে নিন। পাইলেও পাইতে পারেন আশ্চর্য প্রদীপ!

.