ইতিহাস ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন
বিজ্ঞানী থেকে চিত্রপরিচালক হয়েছেন, এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না কোনও পূর্বতন পরিচালকের নাম। নাসা (NASA) থেকে ফেরত তো নয়ই।
শর্মিলা মাইতি
রেটিং- ****
বিজ্ঞানী থেকে চিত্রপরিচালক হয়েছেন, এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না কোনও পূর্বতন পরিচালকের নাম। নাসা (NASA) থেকে ফেরত তো নয়ই। তবে বিজ্ঞানী থেকে পরিচালক হলে কী উচ্চতার ছবি বানানো যেতে পারে, চিটাগং তার অন্যতম ঐতিহাসিক আলেখ্য হয়ে থাকবে। ভদ্রলোক সিনেমা আর ক্যামেরার অ্যানাটমি গুলে খেয়েছেন। ইনিই আবার রেড ক্যামেরার অন্যতম জনক। কাজেই টেকনিক্যাল ব্রিলিয়ান্স এবং ইতিহাসের অনুপুঙ্খ, দুটোই বড়রকমের দাবি ছিল। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এখনও ইতিহাস বইয়ের একটা চ্যাপ্টার। মাস্টারদা সূর্য সেন এখন একটি মেট্রো স্টেশন। বড় জোর একটা কলকাতার গলিরাস্তা। এমনই একটি ক্ষয়মান স্মৃতির যুগে বিপ্লবী চিন্তাধারাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে ধরা বড়সড় চ্যালেঞ্জ। প্রথম ছবিতেই পরিচালক বেদব্রত যেভাবে ‘রুপোলিকরণ’ করলেন, নিঃসন্দেহে সিনেমা গবেষকদের কাছে এক বিস্ময়।
২০০৬ সালে মারা গিয়েছেন বিপ্লবী মার্ক্সবাদী সুবোধ রায়। ছবির নায়ক ঝুঙ্কু (সুবোধ রায়ের ডাকনাম) মাস্টারদার ছাত্র। বড়লোক বাবার ছেলে হয়েও মাস্টারদার বক্তব্যে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতৃকার আরাধনায় মৃত্যুহীন হওয়ার রাস্তায় হাঁটে। গল্প বলার এই ধরনটিরও প্রশংসা প্রাপ্য। এক তরুণ তাজা কিশোরের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গোটা ছবির গল্প সাজানো। ইচ্ছে করলেই গল্পটা মাস্টারদার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলাই যেত। কিন্তু প্রোটাগনিস্ট নির্বাচনের এই মুনশিয়ানা একটা অন্য শাণিত বক্তব্য পেশ করল দর্শকের কাছে। আমজনতার সঙ্গে আরও বেশি নিবিড় সংযোগস্থাপন করল, মাস্টারদা নায়ক হলে ভ্যালু জাজমেন্টের পথে চলে যেতে পারত। যে-ব্যাপারটা ঘটেছিল বোস-দ্য ফরগটন হিরো-র ক্ষেত্রে।
ইতিহাসনির্ভর ছবির ক্ষেত্রে আরও একটা বড় চ্যালেঞ্জ সেটিং। গ্রাম থেকে জেলের গরাদ, উনিশশো তিরিশ-চল্লিশের দশক যেন সটান উঠে এল ছবির পর্দায়। মাস্টারদার ফাঁসির পর, জেলফেরত ঝুঙ্কু আবার গ্রামবাসীদের জড়ো করে আন্দোলনের প্রকল্প নেয়। অস্ত্রহীন গ্রামবাসীদের দলেদলে একত্র হওয়া, আলপথ ধরে হেঁটে চলার দৃশ্যভাবনাও দারুণ।
আশুতোষ গোয়ারিকরের ছবির কাস্টিং-এ এক ঝাঁক বিখ্যাত নাম ছিল, যাদের দেখে মোটেই কিশোর মনে হয় না। মাস্টারদার আদর্শে অনুপ্রাণিত ছাত্র এখানে প্রকৃত অর্থেই কিশোর। ইতিহাসকে পুরোপুরি সিনেমাকরণের জন্য যতটা বিশ্বাসযোগ্য উপাদান যোগানো সম্ভব, সেখানে একশ ভাগ সফল বেদব্রত। অবাক লাগে ভাবতে, আশুতোষের ছবির সঙ্গেই রিলিজ করার কথা ছিল এই ছবির। কোনও এক অজানা কারণে তখন ছবিটি রিলিজ করতে দেওয়া হয়নি। সবুরে যে মেওয়া ফলে কথাটা নেহাত ফ্যালনা নয়।
দেখার মতো ছবির কাস্টিং। বিদেশি ও দেশি অভিনেতাদের নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য সমাবেশ। লগান ছবিতে আমরা দেখেছি। ইদানীং স্মল বাজেটের ছবিতেও বিদেশি অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরই দেখা যাচ্ছে চরিত্রের প্রয়োজনে। ব্যারি জনের অভিনয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মনোজ বাজপাইকে মাস্টারদার চরিত্রে পুরোপুরি একাত্ম করে দেওয়া গিয়েছে খুব সফলভাবে। সঠিক চুলের ছাঁট আর মুখের গড়ন মাস্টারদা সূর্য সেনের ছবির আদল পাওয়া যায়। আশ্চর্য মুখের মিল কিশোর ঝুঙ্কুর সঙ্গে আন্দামান জেলফেরত যুবক ঝুঙ্কুর। এমনকী ছবির শেষে রিয়্যাল লাইফে হসপিটালের বেডে শেষ দিন গুনছেন যে-বৃদ্ধ, তাঁর মুখাবয়বও কী অদ্ভুত মিলে যায় রিল লাইফের সঙ্গে যে, না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ছবির শেষে ডকুমেন্টেশন হৃদয় ছুঁয়ে যায়। চট্টগ্রামের নায়করা পরবর্তী জীবনে কী হয়েছেন, সেটিও জানা গেল এই ছবিরই মারফত্। ইনফর্মেশনের ট্রাফিক জ্যাম নেই। আপনা থেকেই যেন ছবির ভিতরে ঢুকে গেলেন দর্শক। গোটা ছবি জুড়ে এই ইনফর্মেশনের চাহিদা তৈরি হয়েছে আপনা আপনি।
তবে, সংলাপ বলার ক্ষেত্রে আর একটু ধৈর্য ধরা যেতে পারত। আরও একটু সচেতনতা কাম্য ছিল প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দারের চরিত্র নির্বাচনে। এই চরিত্রের অভিনেত্রী ভেগার মুখটি এত নিষ্পাপ সুন্দর যে তাতে বিপ্লবীসুলভ কাঠিন্য ফুটে ওঠে না অনেক চেষ্টাতেও। কস্টিউমেও অসঙ্গতি নজরে পড়ে। মেক আপ কখনও মুখে দৃঢতা এনে দেয়, কখনও বা মোলায়েম ভাব। প্রায়ই বদলে যায় ঠোঁটের রেখা, খোঁপার আয়তন। খুবই সামান্য খুঁত যদিও। গোটা ছবিতে প্রায় অদৃশ্য। তবুও!