শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মায়ের আদলেই তৈরি 'গোত্র'র মুক্তিদেবী: অনুসূয়া
রণিতা গোস্বামী
রণিতা গোস্বামী
কাছের মানুষ হতে গেলে কি 'গোত্র' লাগে? এরকমই হাজারও প্রশ্ন ও সামাজিক বার্তা নিয়ে আসছে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নন্দিতা রায়ের আগামী ছবি 'গোত্র'। ছবি মুক্তির আগে একান্তে Zee ২৪ ঘণ্টা ডিজিটালের সঙ্গে একান্তে কথা বললেন 'গোত্র'র মুক্তিদেবী অর্থাৎ অনুসূয়া মজুমদার।
ছবির ট্রেলারে বেশকিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে কাছের মানুষ হতে গেলে কি 'গোত্র' লাগে নাকি? এক্ষেত্রে আপনার ব্যক্তিগত মতামত কী?
অনুসূয়া মজুমদার- দেখো, আমরা যখন বন্ধুত্ব করি, কারোর সঙ্গে কথা বলি, আমাদের মাথায় কি একবারও আসে অন্য ব্যক্তিটি কোথা থেকে এসেছে? তার জাত কী? তখন তো এসব নিয়ে একদমই ভাবি না। ভার ভাববোই বা কেন? এই গোত্র, জাতপাত আমার কাছে এক্কেবারেই গুরুত্বহীন। এই ঠুনকো বিষয়গুলি কারোর কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত বলেও আমার মনে হয় না। তবে নিজের জাতের বাইরে গিয়ে বিয়ের বিষয় নিয়ে সমাজে চিরকালই সমস্যা তৈরি হয়েছে, অনেক বাধা এসেছে। ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণের সঙ্গেই বিয়ে করবে, ওমুক জাতে কখনওই বিয়ে দেওয়া যায় না, তার অন্য গোত্র, এগুলো এখনও হয়েই থাকে, তবে এই বিষয়গুলি আমার কাছে এক্কেবারেই যুক্তিহীন। আমি এগুলো নিজে কখনও মানি নি, আমার পরিবারে কখনও মানা হয়নি। আর সমাজের কথা যদি বলো, তাহলে বলবো সকলে জাতপাত নিয়ে ব্যস্ত থাকলে ভবিষ্যৎ যে কোন দিকে যাবে তা নিয়ে সত্যিই চিন্তা হয়।
বয়স্কদের জন্য কলকাতা শহর সত্যিই কি সুরক্ষিত নয়? 'গোত্র' ট্রেলারে যে প্রশ্নটা তুলে দেওয়া হয়েছে, অনুসূয়া দি আপনি নিজে একজন সিনিয়ার হিসাবে কী বলবেন?
অনুসূয়া মজুমদার- সুরক্ষিত নয়, তবে করতে হবে। আর এ দায়িত্ব অনেকেরই। সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে পুলিস, প্রশাসনের দায়িত্বের কথা ছেড়েই দিলাম, তাঁদের তো দায়িত্ব রয়েছেই। আমার মনে হয় সমাজের প্রত্যেকটা মানুষের একটা দায়িত্ব থাকা উচিত। যেহেতু যুগ বদলেছে, সন্তানেরা পড়াশোনা করছে, তাঁরা চাকরি করতে বাইরে তো যাবেই। তা সে রাজ্যের বাইরে, নয়ত দেশের বাইরে। আর বাবা-মা সবসময়ই চাইবে ছেলেমেয়েরা ভালো কাজের সুয়োগ পেলে বাইরে যাক, আমার ছেলেই তো বাইরে থাকে। আমি তো সব ছেড়ে কখনওই ওর কাছে যেতে চাইবো না, আমি আমার জায়গায় স্বাধীন ভাবে থাকতে চাই। আর বাবা-মাকে তাঁদের শিকড় থেকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া উচিতও নয়।
তবে দেখো সমস্যা হল বয়স হলে বিভিন্ন রকম সমস্যা হয়, তাঁরা নির্ভরশীল হয়ে যায় অন্যের উপর। সেই সুযোগগুলো ব্যবহার করেই অনেকে ক্ষতি করেন। সাম্প্রতিককালে যে ঘটনাগুলো ঘটছে সেগুলো সত্যিই চিন্তার কারণ। তবে আমাদের তো বয়স্কদের নিরাপত্তা দিতেই হবে। আমি মনে করি, সমাজের মানুষগুলো যদি কিছুটা দায়িত্ব নেয় তাহলেই বিষয়টা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। যেমন বয়স্ক মানুষের বাড়িতে যদি কাজের লোক থাকে, তাহলে তাঁদের নাম, আইডি কার্ড নিয়ে রাখা। প্রতিবেশীরাই যদি একটু খোঁজ খবর রাখেন তাহলেই অনেকটা সমস্য়া কমে। আগের মতো এখন আর কেউ কারোর বাড়ি যায় না। একান্নবর্তী, যৌথ পরিবার আর বিশেষ নেই, তাই সমস্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
মানসিক অবসাদ থেকে আত্মহত্যা, এই যে বিষয়টা ট্রেলারে উঠে এসেছে, এটা তো শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সমস্য়া নয়, সাম্প্রাতিককালে অল্পবয়সীদের মধ্যেও এই আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হচ্ছে, এনিয়ে আপনার কী মত?
অনুসূয়া মজুমদার- দেখো, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এই সমস্যাটা একাকীত্ব থেকেই বেশি হয়। আর অল্প বয়সীদের মধ্যে নানান কারণে সমস্য়াটা আসে। পড়াশোনার চাপ, বাবা-মায়ের আকাঙ্খা পুরণের চাপ থাকে, এছাড়াও নানান কারণ থাকে। আমার মনে হয়, তাঁদের মন বোঝা উচিত বাবা-মাযের। অহেতুক চাপ সৃষ্টি করা উচিত নয়। সবার মেধা তো সমান নয়। সকলকেই যে পড়াশোনা করে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার হতে হবে এমনটা তো নয়, আরও অনেককিছুই করার থাকে। আজকাল বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আসলে আমার মনে হয়, আমাদের চিন্তাধারাটা একটু বদলাতে হবে। সমাজের সঙ্গে নিজেদেরকেও বদলাতে হবে।
আচ্ছা, ব্যক্তিগতভাবে আপনি কি কখনও মানসিক অবসাদের শিকার হয়েছেন? হয়ে থাকলে তা কীভাবেই বা কাটিয়ে উঠেছেন?
অনুসূয়া মজুমদার- (একটু ভেবে) না, সেটা কখনও হয়নি। 'ইমোশননাল সিচুয়েশন' আমি সামলাতে পারি। আর এই ক্ষমতাটা আমি আমার বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। তবে এধরনের অনেক ঘটনারই আমি সাক্ষী থেকেছি। সমস্যা হল, অনেকেই কাউন্সিলিং করতে অস্বস্তি বোধ করি। কেউ আবার কাউন্সিলিং বিষয়টাই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন না, অথচ এটা খুব সাধারণ একটা বিষয়। কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে অবসাদ থেকে বেরিযে আসা যায়। কারোর সঙ্গে একটু কথা বললে যদি ভালো থাকি তাহলে ক্ষতি কী বল তো?
আর আমার মনে হয় 'গোত্র' সমাজের ছোট অথচ গভীর সমস্যাগুলি তুলে ধরবে। পথ দেখাবে।
ট্রেলারে জন্মষ্টমীতে মুসলিম যুবকের প্রসাদ বিতরণে আপত্তি তুলেছেন খরাজ মুখোপাধ্যায়, এবিষয়টা সঙ্গে সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া 'জ্যোমাটো'র ঘটনার সঙ্গে কি কোনওভাবে মিলে যাচ্ছে না?
অনুসূয়া মজুমদার- যে ঘটনাটা ঘটেছে তাতে সত্যিই আমি অবাক। কিছুই বলার ভাষা নেই। 'গোত্র'তে দেখানো হয়েছে, আগ্রায় যে জন্মাষ্টমী পালিত হয় সেখানে আলিগরের কারিগররা পিতলের মূর্তি গড়েন। ওই মূর্তি পূজো করার সময় তো আমরা কখনও জিজ্ঞাসা করিনা কে বানিয়েছে মূর্তিটা? তাহলে এখানে কেন প্রশ্ন উঠছে? 'জ্যোমাটো'র ঘটনাটা খুবই হাস্যকর বলেই আমার মনে হয়।
শ্যুটিং ফ্লোরের কিছু অভিজ্ঞতা যদি শেয়ার করতেন?
অনুসূয়া মজুমদার- শ্যুটিং ফ্লোরের কথা আমার সবসময়ই মনে থাকবে। 'গোত্র'র গোটা শ্যুটিংযের অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে একটা সম্পদ বলতে পারো। কী হত জানো তো, মানালি তো ভীষণই প্রাণবন্তো একটা মেয়ে। শ্যুটিংয়ে নাইজেল ও মানালির মধ্যে সবসময়ই খুনসুটি চলত। এতে আমরা বেশ মজাই পেতাম। এ ওর চটি লুকোচ্ছে, তো ও ওর মাথায় জল ঢেলে দিচ্ছে। কে খাবার নিয়ে চলে যাচ্ছে। এগুলো শ্যুটিংয়ে চলতেই থাকতো। আর মাঝখানে আমায় রেফারি করে দিত। দেখো দিদি, কী বলছে, আমার মনে হয় অফস্ক্রিনে পুরো রসায়নটা আমাদের মধ্যে এত ভালো ছিল বলেই অনস্ক্রিন রসায়নটা সুন্দরভাবে ধরা পড়েছে।
আর পরিচালনার কথা যদি বলো, নন্দিতা ও শিবুর (নন্দিতা রায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) প্রশংসা করলেও কম করা হয়। ওরা এত উৎসাহিত করেছে যে বলার নয়। তাছাড়া প্রত্যেকে ভালো কাজ করেছে। এত ভালো ভালো সব অভিনেতা (একটু থেমে) খরাজ, সন্তু দা, অম্বরীশ, সাহেব, বাদশা, বিশ্বনাথ, কাকে ছেড়ে কার কথা বলবো! আমরা সবাই এতো মজা করে কাজ করেছি যে শ্যুটিং ফ্লোরটা আমার কাছে একটা বড় পিকনিক বলে মনে হতো। কোথাও খারাপ লাগা, মন খারাপের জায়গাই নেই।
'গোত্র'তে মুক্তিদেবী একজন অত্য়ন্ত রাগী ও শুচিবায়ুগ্রস্ত। আপনার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে এই চরিত্রটার কোথায় পার্থক্য?
অনুসূয়া মজুমদার- (হাসি) না, না, শুচিবায়োগ্রস্ত আমি এক্কেবারেই নই। তবে হ্যাঁ, একটু পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে আমি পছন্দ করি। অপরিস্কার, অগোছালো ঘর আমার পছন্দ নয়। তা বলে এই নয়, অন্য কারোর বাড়িতে গিয়ে আমি যদি অগোছালো দেখি, তাহলে বিরক্ত হবো। আর এককালে আমি ভীষণই রাগী ছিলাম ঠিকই, তবে এখন আর নই। (আবারও হাসি)
'মুখার্জিদার বউ' এর পর ফের একটা কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অভিনয় করছেন কেমন লাগছে?
অনুসূয়া মজুমদার- আমি শিবু ও নন্দিতার কাছে কৃতজ্ঞ যে পরপর এধরনের দুটো চরিত্র করতে পারলাম। আর একজন বয়স্ক মহিলাকে কেন্দ্র করেই যে ছবিটা হলো, আমি যে এই চরিত্রের জন্য নিজেকে এতটা ভাঙতে পেরেছি, আমাকে এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে, এটা ভেবেই বেশ ভালো লাগছে। আসলে 'গোত্র'র মুক্তিদেবীর চরিত্রটা শিবপ্রসাদের মায়ের আদলে তৈরি। আমাকে যে এতটা কাছের মনে করে এতটা দায়িত্ব শিবু দিয়েছে, এটা আমার কাছে বিরাট একটা পাওয়া।
আমি মাসিমার সঙ্গে কথা বলেছি, ওনার একজন দেখাশোনার লোক ছিল। তাঁকে নিয়েও ওনার প্রশ্ন ছিল ও কেন বিভূতিভূষণ পড়েনি, সাহিত্য পড়েনি? শিবু বলতো, মা ওরা কী করে পড়বে? উত্তরে উনি বলতেন কেন নয়? তো সেই ব্যপারটা একদিকে উনি শুচিবাই। অন্যদিকে উনিই আবার নাটক লেখেন, পড়াশোনা করেন পাগলের মতো, রান্না করেন। ওনার ব্যক্তিত্বটাই এতো অসাধারণ লেগেছে, যে সেটাকে ছবিতে ফুটিয়ে তোলাই আমার কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল।
এধরনের ছবি কি আরও হওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয় না?
অনুসূয়া মজুমদার- অবশ্যই। আমার মনে হয়, এধরনের অনেক চরিত্র রয়েছে। সকলের বাড়িতেই মা, বাবা, জ্যেঠু, কাকা, ঠাকুমারা আছেন, এনারা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছেন, তো এধরনের একটা চরিত্রকে নিয়ে ভাবতে অসুবিধা কোথায়? সিনেমা বানাতে অসুবিধা কোথায়? এতে সমাজের একটা উপকার হবে। বয়স্করা মনে করবেন তাঁদের নিয়েও ভাবা হচ্ছে, ছবি হচ্ছে। শিবু-নন্দিতার ছবিতে বরাবরই একটা সামাজিক বার্তা থাকে। জোর করে নয়, খুব সহজভাবে ওরা সমাজের কাছে একটা বার্তা পৌঁছে দেয়।
আগামী দিনে আর কোন ছবিতে আপনাকে দেখতে পাবো?
অনুসূয়া মজুমদার- আমার আরও একটা ছবির শ্যুটিং শেষ হয়েছে শৈবাল মিত্রর 'দেবতার গ্রাস', যেখানে আমি ক্যামিও করেছি। সৌমিত্রদার (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) স্ত্রীর চরিত্রে।