স্মরণ: ৫ সেপ্টেম্বর
আসানসোল থেকে দশ-বারে কিলোমটার হবে। উদাসপর গাঁ। গাঁ হলেও বেসিক স্কুল, হাই স্কুল, মেয়েদের স্কুল মিলে তিন তিনটে স্কুল সেখানে। তো সেই হাই স্কুলে পড়াতে এলেন শৈলেন মুখুজ্যে। ওই গাঁয়েরই ছেলে। কলকাতা থেকে স্নাতক। ইচ্ছে ছিল প্রেসিডেন্সিতে উচ্চশিক্ষার। কিন্তু পিছুটান পাঁচ ভাই-বোন। তাঁর বাবা তারাচরণও স্কুল মাস্টার।
আসানসোল থেকে দশ-বারে কিলোমটার হবে। উদাসপুর গাঁ। গাঁ হলেও বেসিক স্কুল, হাই স্কুল, মেয়েদের স্কুল মিলে তিন তিনটে স্কুল সেখানে। তো সেই হাই স্কুলে পড়াতে এলেন শৈলেন মুখুজ্যে। ওই গাঁয়েরই ছেলে। কলকাতা থেকে স্নাতক। ইচ্ছে ছিল প্রেসিডেন্সিতে উচ্চশিক্ষার। কিন্তু পিছুটান পাঁচ ভাই-বোন। তাঁর বাবা তারাচরণও স্কুল মাস্টার। এতবড় সংসারের হাঁড়ি তাঁর একার পক্ষে সামলানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই জেষ্ঠ্যপুত্রকেই হাল ধরতে হয়। আর কিছুদিন পড়াতে না পড়াতেই সুখ্যাতি ছড়ালো আরও দশটা গাঁ-গঞ্জে। সেই থেকে তিনি সবার শৈলেন মাস্টার।
বিয়ে থা হল। ছেলে মেয়ে হল। গাঁয়ের স্কুলেই শুরু হল তাদের পাঠও। হ্যারিকেনের আলোয়। কিন্তু ওই আলোয় থেমে রইলেন না শুধু শৈলেন মাস্টার। কলকাতায় তাঁর নিত্য আনাগোনা। কলেজ স্ট্রিট থেকে কিনে আনতেন বই। আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে গেল প্রাইভেটে স্নাতকোত্তর। ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণও হলেন। লিখে ফেলেন গবেষণাপত্রও। ততদিনে হারিয়েছেন বাবাকে। তারাচরণের চলে যাওয়ায় সংসার আরও পিছল হয়ে ওঠে। কাঁধ আরও প্রশস্ত করতে হয় শৈলেন মাস্টারকে। গাঁয়ের স্কুল ছেড়ে শহরের কলেজে অধ্যাপনার সুয়োগ পান। উদাসপুরেই রেখে যান স্ত্রী-সন্তানদের। তিন ভাইয়ের বিয়ের ব্যবস্থা, দুই ভাইকে কলেজে ভর্তি, একমাত্র বোনের বিয়ে। শৈলেন মাস্টার অক্লান্ত।
ছোট ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যান শহরে। নিজের কাছে রেখে ভালো স্কুলে পড়ানোর স্বপ্ন নিয়ে। একদিন ছেলে স্কুলে পড়া পারেনি। কলেজ ফেরত ছেলেকে নিতে গিয়ে মাস্টার দেখেন সে বাইরে নীল ডাউন। সেদিন বাড়ি ফিরে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিলেন শৈলেন মাস্টার। আর বলেছিলেন, "পড়াশুনোকে বুকে জড়িয়ে ধরবি। এমনিভাবে। দেখবি এর চেয়ে পৃথিবীতে সুন্দর কিছু নেই।"
ক্লান্তিহীন তাঁর পড়াশুনো, ক্লান্তিহীন তাঁর পড়ানো। কার্যত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যই উত্সর্গ শৈলেন মাস্টারের জীবন। আবার এই মাস্টারই কখনও দায়িত্বশীল দাদা, অপূর্ব প্রেমিক, স্নেহশীল পিতা। অমায়িক বন্ধু।শৈলেন মাস্টার তখন উদাসপুরে পড়ান। প্রবল বৃষ্টিতে একদিন স্কুলে যেতে পারেননি। পরদিন স্কুলে যেতেই এগিয়ে আসে ক্লাসের মেধাবী ছাত্রটি। ক্লাস ইলেভেনের অপূর্ব। অনেক দূরের এক গাঁ থেকে আসে পড়তে। মাস্টার জিজ্ঞেস করেন, 'কিছু বলবি?' ব্যাকুল চোখে অপূর্ব বলে, "কাল আপনি আসেননি স্যার। খুব বৃষ্টি হচ্ছিল জানি, কিন্তু আমি এসেছিলাম। শুধু আপনার ক্লাসের জন্য।" এরপর নিতান্ত শারীরিক বা পারিবারিক কোনও কারণ ছাড়া শৈলেন মাস্টার তাঁর কর্মজীবনে আরও কখনও অনুপস্থিত থাকেননি।
সংসার দীর্ঘ হয়েছে। খরচও বাড়ে নিত্যদিন। তাই আরও একটু উপার্জনের জন্য এক শহরের কলেজ থেকে আর এক শহরে পাড়ি দেন। তবে আর অধ্যাপনা নয়। পাল্টে যায় জীবিকা। জীবিকা বদলালেও শৈলেন মাস্টারেরও জীবন বদলায় না। পড়াশুনো আর শিক্ষকতা তাঁর জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রোত জড়িয়ে থাকে। জড়িয়ে থাকে জীবনভর। শৈলেন মাস্টার অবসর নিয়েছেন অনেকদিন। অধ্যয়নই আজও তার দিনযাপনের সেতু।
বছরখানেক আগে হৃদযন্ত্রে বড়সড় অসুখ হয়েছিল তাঁর। সদ্য বাড়ি ফিরেছেন। হঠাত একদিন দেখেন বাড়িতে অনেক মানুষ। হাতে ফুল। মাস্টার কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সহস্র ফুল ছড়িয়ে পড়ে তাঁর শরীরে। আর সবাই একসঙ্গে বলে ওঠে, "Thou hast removed the darkness from inner eyes by applying collyrium of knowledge, my mentor, my perceptor, thousand salutaions to you..." দূর দূরান্তে ছড়িয়ে থাকা তাঁর ছাত্র ছাত্রীরা তাঁর সামনে। শৈলেন মাস্টারের অশক্ত হাত ধরে থাকে তাঁরই হাতে তৈরি অনেক বলিষ্ঠ প্রত্যয়।
এইপর্যন্ত বলে হয়তো আমার মনে হতে পারে, কিছুটা অন্তত বোঝানো গেল। কিন্তু না।
"যতটকু দেখে গেলে ততটুকু নয়, ভালবাসা থেমে আছে আমারও আমূল অন্ধকারে...।"
এই মাস্টারকে আমার প্রণতি...