লে রেপপ্লে গেম অন...
মোদ্দা কথা, আমরা গেমটা হেরে গেছি দাদা। সবংশে হেরে গেছি। ফেসবুকে ঘুরছে মৃত্যুমুখী সুন্দরীর মুখ। এ ঘুমোনো মেয়ে পৃথিবীর। এরে লয় শুষে- দেবতা, গন্ধর্ব, নাগ, পশু ও মানুষে। ততোধিক সুন্দর তার কোটরে বসে যাওয়া রক্তচোখ, পচে যাওয়া নাড়িভুঁড়ি, লোহার রডের আদরে বিকল হতে থাকা শরীরযন্ত্র। সারা দেশ জুড়ে এই অনাম্নী অঙ্গনার জন্য প্রতিবাদে সোচ্চার, বিদ্রোহে উত্তাল জনগণ। মোমবাতির নৈঃশব্দে সরব তারকারা। ধর্ষকের শাস্তি চাই। প্রকাশ্য রাস্তায় ফাঁসি চাই। ন্যাংটো করে প্যারেড করাতে চাই, ইঁট ছুড়ে ছুড়ে মারতে চাই, চাই চাই... পিঠ ঠেকে গেছে আমাদের। এমন শাস্তি চাই যেন নিদর্শন হয়ে থাকে। ওই তো শুয়োরের বাচ্চারা... ওরাই তো রেপ করেছিল না? ধরে আন ব্যাটাদের। আইন আইনে থাকুক। আমরা ওদের জবাই করি। ওদের মধ্যে নাকি একটা নেহাত গোঁফ-ওঠা ছোকরা? তাতে কী... পুরুষ পুরুষ। ওদের অত শ্রেণিবিভাগ হয় না। নরম ছিদ্রে গাড়ির পার্টস ঢুকিয়ে মজা মারতে সবাই সমান। ভাবনা, রাগ, দুঃখ আর ঘেন্না মনের মধ্যে এমন কিলবিল করছে যে উগরে না দেওয়া অবধি স্বস্তি নেই। বড় দেরি হয়ে গেল কলম তুলতে। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালেই জীবনযুদ্ধ শেষ। থার্টিফার্স্ট নাইট পেরিয়ে নিউ ইয়ার এসে গিয়েছে। কাঁদো দেশ কাঁদো। কেঁদে তোমাদের আবেগের নদীতে প্রতিবাদের প্ল্যাকার্ডগুলো ফেলে দাও। ধর্ষণ আর হেডলাইন নেই। সাইডলাইনে চলে এসেছে। এক কলমে সেরে দেওয়া হয়েছে। ইস্যু বদলে গেছে। নেতায়-নেতায় ইয়ে হচ্ছে, জীবন বয়ে যাচ্ছে। ধর্ষিতারা পুলিসে কমপ্লেন করতে গিয়ে ফের হেনস্থা হচ্ছে। মেডিক্যাল টেস্টে ধর্ষণের কিচ্ছুটি প্রমাণ মিলছে না। গায়ে একটি আঁচড়ও দেখা যাচ্ছে না আতশকাঁচে। 'প্রেক্ষিত' পাল্টে যাচ্ছে, কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না। এমনই শোকেসে সাজানো ঘটনা হয়ে যাচ্ছে... বাড়ির বাচ্চা প্লাস্টিকের ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে ধোনি-ধোনি খেলতে খেলতে মাকে শুধোচ্ছে, মা, মা ধর্ষণ কী করে খায়?
রেডি স্টার্ট। এক জিন্স-টিশার্ট পরা মাঝবয়সি মহিলার পেছনে ধাওয়া করছে কারসর। ল্যাপটপের সামনে সজাগ চোখ। কামনায় অবশ। মহিলার আর্ত-শীত্কার আরও বেশি উষ্ণতা ছড়াচ্ছে। পুরুষটি জিভের নাল ঢোঁক গিলে ফেলছে, আরও উত্তেজনার আশায়। ধাওয়া করে ধরা গেল সেই নারীকে। মাউসক্লিকের আক্রমণে নিমেষে বিবস্ত্র করা হল তাকে। আঙুলের টিপে নানান 'অ্যাভেলেবল অপশনে' প্রক্রিয়ায় ধর্ষণ করে চলল ক্রীড়ারত পুরুষ। শেষ হলে ধর্ষিতার দেহে স্প্রে করে দিল থকথকে সাদা সিমেন। এর পরের ধাপেই ছাড়পত্র মিলবে তার দুটি ফুটফুটে মেয়েকে ধর্ষণের। উল্লাস! এখানেই শেষ নয়, স্টেপ টু থ্রি পেরিয়ে যথেষ্ট পয়েন্ট সংগ্রহের পর, স্টেপ ফাইভে তুলতুলে নরম এক রাজকন্যেকে গণধর্ষণের পর্ব। সারা রাত কখন কোথা দিয়ে কেটে যাবে। উল্লসিত, পরিতৃপ্ত পুরুষ লগ আউট করে, দিব্যি হাত ঝেড়ে-ঝুড়ে ঘুমোতে চলে যাবেন...
গেমটা নাকি ব্যান করেছিল আর্জেন্টিনা সরকার। সেক্সুয়াল কন্টেন্ট অ্যান্ড ভ্যালোরাইজেশন অফ রেপ। মায় সেক্স সিটি থাইল্যান্ডেও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে এই গেমের সিডি। পুলিশ রেড করে আস্তাকুঁড়ে ফেলেছে। তবু এই পোড়া দেশে, দিল্লির রাস্তায়, যখন 'শয়ে 'শয়ে ছেলে-মেয়ে-বাবা-কাকা-দিদি-দাদারা মোমবাতি জ্বালিয়েছিলেন রাজভবনের সামনে, তখনই রমরম করে বিকোচ্ছিল এই ভিডিও গেমের সিল করা ডিভিডি। দিল্লির আর এক প্রান্তে। দেড় হাজার কা এক! ছি-ছি করে উঠলেন আবার? দোষের কী হল? আরে বাবা, স্বমেহনের জন্য এর চেয়ে ভাল বিকল্প আর আছে কি? থাকলে বলবেন। জানতে ইচ্ছা করি।
মোদ্দা কথা, আমরা গেমটা হেরে গেছি দাদা। সবংশে হেরে গেছি। ফেসবুকে ঘুরছে মৃত্যুমুখী সুন্দরীর মুখ। এ ঘুমোনো মেয়ে পৃথিবীর। এরে লয় শুষে- দেবতা, গন্ধর্ব, নাগ, পশু ও মানুষে। ততোধিক সুন্দর তার কোটরে বসে যাওয়া রক্তচোখ, পচে যাওয়া নাড়িভুঁড়ি, লোহার রডের আদরে বিকল হতে থাকা শরীরযন্ত্র। সারা দেশ জুড়ে এই অনাম্নী অঙ্গনার জন্য প্রতিবাদে সোচ্চার, বিদ্রোহে উত্তাল জনগণ। মোমবাতির নৈঃশব্দে সরব তারকারা। ধর্ষকের শাস্তি চাই। প্রকাশ্য রাস্তায় ফাঁসি চাই। ন্যাংটো করে প্যারেড করাতে চাই, ইঁট ছুড়ে ছুড়ে মারতে চাই, চাই চাই... পিঠ ঠেকে গেছে আমাদের। এমন শাস্তি চাই যেন নিদর্শন হয়ে থাকে। ওই তো শুয়োরের বাচ্চারা... ওরাই তো রেপ করেছিল না? ধরে আন ব্যাটাদের। আইন আইনে থাকুক। আমরা ওদের জবাই করি। ওদের মধ্যে নাকি একটা নেহাত গোঁফ-ওঠা ছোকরা? তাতে কী... পুরুষ পুরুষ। ওদের অত শ্রেণিবিভাগ হয় না। নরম ছিদ্রে গাড়ির পার্টস ঢুকিয়ে মজা মারতে সবাই সমান। ভাবনা, রাগ, দুঃখ আর ঘেন্না মনের মধ্যে এমন কিলবিল করছে যে উগরে না দেওয়া অবধি স্বস্তি নেই। বড় দেরি হয়ে গেল কলম তুলতে। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালেই জীবনযুদ্ধ শেষ। থার্টিফার্স্ট নাইট পেরিয়ে নিউ ইয়ার এসে গিয়েছে। কাঁদো দেশ কাঁদো। কেঁদে তোমাদের আবেগের নদীতে প্রতিবাদের প্ল্যাকার্ডগুলো ফেলে দাও। ধর্ষণ আর হেডলাইন নেই। সাইডলাইনে চলে এসেছে। এক কলমে সেরে দেওয়া হয়েছে। ইস্যু বদলে গেছে। নেতায়-নেতায় ইয়ে হচ্ছে, জীবন বয়ে যাচ্ছে। ধর্ষিতারা পুলিসে কমপ্লেন করতে গিয়ে ফের হেনস্থা হচ্ছে। মেডিক্যাল টেস্টে ধর্ষণের কিচ্ছুটি প্রমাণ মিলছে না। গায়ে একটি আঁচড়ও দেখা যাচ্ছে না আতশকাঁচে। 'প্রেক্ষিত' পাল্টে যাচ্ছে, কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না। এমনই শোকেসে সাজানো ঘটনা হয়ে যাচ্ছে... বাড়ির বাচ্চা প্লাস্টিকের ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে ধোনি-ধোনি খেলতে খেলতে মাকে শুধোচ্ছে, মা, মা ধর্ষণ কী করে খায়?
আমরা ঠারেঠেরে জানি, এদেশে প্ল্যাকার্ড-মোমবাতি-শোকমিছিল নেহাতই প্রতীকী-বইয়ে জায়গা পায়। ধর্ষণ বড় শাশ্বত, অনির্বার্য। ধর্ষিতা নারী সমাজের অ্যাসেট। ইতিহাসে সম্ভোগের আকর। বিজয়ী রাজার সম্পত্তি। দেশভাগের সময়ে ধর্ষ-পুতুল। সেনাবাহিনীর টাইমপাস। বিশ্বাস করুন ছাই না করুন, এই যুগেও ধর্ষিতা নারী আসলে বেশ উগ্র স্বাদবদল। সংবাদমাধ্যম, চায়ের কাপ, কলতলা থেকে ব্যবসার বাজার সবই কাঁপিয়ে দেয় কিছুদিনের জন্য। 'ব্যবসা' শব্দটা এমনি এমনি ইউজ করিনি দাদা। নমুনা চান, হালের ঘটনাই ধরুন। একটা ধর্ষণের কেস পেলে উকিল বর্তে যান। আইনের প্যাঁচে প্যাঁচে ওষ্ঠাগত হয় ধর্ষিতা। বছর বছর চলার পর নেহাতই আলুভাতে হয়ে যায়। চেন্নাইয়ে বছরদুয়েক আগে এক গণধর্ষণের শাস্তি ধরা হয়েছিল মাথাপিছু পাঁচ হাজার টাকা! পকেট থেকে বের করেই খালাস। তার পরে ধরুন সংবাদমাধ্যম। তেমন জোরদার কোনও কেস পেলে অনায়াসে আট-দশ দিনের খাবার হয়ে যায়। ফিল্ডের সাংবাদিকদের শুখতলা ক্ষুইয়ে খবর খুজে বেড়াতে হয় না। চ্যানেলে চ্যানেলে আলোচনার টপিক ঠিক হয়ে যায়। সেলিব্রিটিরা মুখে মেকআপ নিয়ে, ধর্ষণের একাল-সেকাল বক্তৃতা দেন। রাজনীতিবিদরাও খানিক বলেন-টলেন। তার মধ্যেই বেসামাল কথাবার্তা নিয়ে আবার খবর হয়। ইউটিউব ভরে যায় মোবাইলে আঁখো-দেখি ভিডিয়োয়। চড়চড় করে বাড়তে থাকে ভিজিটরের সংখ্যা।
লিখতে লিখতেই মনে পড়ল, গত বছর জুলাই মাসে আমাদেরই চ্যানেলের এক নবীন সাংবাদিক একটা নিউজ ব্রেক করেছিলেন। গুড়াপের হোমে মানসিক ভারসাম্যহীন এক বারংবার ধর্ষিতা মহিলার পচা-গলা মরদেহ মাটি খুঁড়ে বের করা হয়েছিল। ন্যাশনাল নিউজ হয়েছিল সেটা। একই দিনে, এক পদকজয়ী মহিলা অ্যাথলিট মেডিক্যাল টেস্টে পুরুষ বলে 'প্রমাণিত' হয়ে সমাজের চোখে ধর্ষিতা হন। আর ওই দিনই, দেশের আর এক প্রান্তে এক ধর্ষিতা ও নিখোঁজ নর্তকীর কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল মাটি খুঁড়ে। হইহল্লার মধ্যে শুধু একটি কথাই মনে হয়েছিল আমার। ধর্ষণ এমনই এক সুতীব্র আকর্ষণ যা নারীর শুকনো খটখটে কঙ্কালকেও শুষে নিতে পারে! মহাভারতের পাতায় পড়েছি, একশতসহস্র বত্সরের স্নিগ্ধতার নির্যাসে না কি তৈরি হয় একজন নারী। তবে কেন কড়ে আঙুলের চেয়েও ছোট ভ্রূণ থাকা অবস্থাতেই চিত্রগুপ্তের খাতায় নাম ওঠে তার। ধনীর পুত্রসন্তানলোভ, দরিদ্রের কন্যাদায় আর মধ্যবিত্তের চাওয়া-না-চাওয়ার ত্রিশূল তাকে পৃথিবীর আলো দেখতেই দেয় না... কতটুকু সম্মানের অধিকারিণী সে!
এখনই এত অস্বস্তিতে পড়বেন না, আরও পার্থিব লেভেলে ভাবুন দেখি। ধর্ষণের প্রতিবাদ করতে গেলে কাঁচি-আঠা-সেলোটেপ-আর্ট পেপারের বিজনেসও ধাঁ করে বেড়ে যায়। মোমবাতি বিক্রেতারাও হঠাত্ সুখের আলো দেখে। দেশ জুড়ে প্রতিবাদী জটলা-জমায়েতে রোডসাইড ধাবাগুলোরও বিক্রিবাটা হয়। টিভি চ্যানেলগুলোতেও কোন অদৃশ্য ঈশারায় কন্ডোমের আর বিদেশি তেলের অ্যাড বেড়ে যায়...
এই তো সেদিন, একটা ওষুধের দোকানে ওষুধ কিনতে গেছি। হঠাত্ একটা ব্যাপার দেখে হাসি চাপতে পারলাম না। দোকানের শোকেসে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত, কর্ণার টু কর্নার জাপান-থেকে-আনানো-ভারতীয়-ভেষজে-বানানো তেলের শিশি। দেখে কী বলব, কী ওষুধ কিনতে এসেছিলাম তার নামটাই ভুলে গেলাম! স্থান-কাল-পাত্র বিস্মৃত হয়ে দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, এত তেল!! মুচকি হেসে দোকানদার বললেন, খুব ডিমান্ড দিদি। কন্ডোম আর কটা বিক্রি হয়... দাদু থেকে খোকাবাবু সবাই এটাই কিনছে...
অতএব পুরুষ, আপনাদের লিঙ্গ আরও লম্বা হোক... চলতে থাকুক রেপ-প্লে। আমরা নারীরা পাতালপ্রবেশ করি। ধর্ষণের লজ্জা থেকে বাঁচার অন্য উপায় তো দেখি না!
ফুলকলি