একটা মৃত্যু আর কিছু ছবি
কোনও বিখ্যাত মানুষ মারা গেলেই আমরা অনেকেই সেই একই শব্দ ব্যবহার করি। এই যেমন অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল, ওনার মৃত্যুতে একটা বড় শূন্যতা তৈরি হল এই সব আর কি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুটাকে শুধু ওভাবে ব্যাখা করা যাবে না। বাকিদের চেয়ে তাঁর লেখা অনেকটা আলাদা ছিল। চিরচারিত ছকের বাইরে তাঁর লেখা তৈরি করেছিল আলাদা ঘরানা। সেই মানুষটার মৃত্যুতে অনেক টুকরো টুকরো ছবিগুলোও আলাদা হয়ে থাকল। সেই ছবিগুলোই প্রমাণ হয়ে থাকল নীললোহিতের শরীরটা আর আমাদের সঙ্গে থাকবে না ঠিকই কিন্তু ওনার চিন্তাভাবনা-লেখা আমাদের জীবনের অনেক কষ্টের মধ্যেও সুখের ঠিকানার খোঁজ দেবে।
পূর্ব পশ্চিমের বেড়া জাল ভেঙে দিকশূন্যপুরে তিনি চলে গেছেন। কিন্তু সেই সময় থেকে এই সময় মানে সব সময় বাঙালির হৃদয়ে প্রথম আলো জ্বেলে দিয়েছে তাঁর লেখা। আসলে জীবন যেরকমই হোক, তিনি আমবাঙালি পাঠকের হৃদয় দ্বীপের রাজা।
তাঁর সেই চিরকালীন কাকাবাবু যেমন সব কিশোরকে পুরুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখায়, তেমনই 'হঠাত্ নীরার জন্য' পড়ে বাঙালি প্রেমের নতুন সংজ্ঞা খুঁজে পায়। আসলে তাঁর লেখায় বাঙালি জাগতে শিখেছে, আবার চিন্তায় মগ্ন পাগল প্রেমিককে ঘুমোতে শিখিয়েছে। এখানেই তাঁর সফলতা। বারোর কিশোর কাকাবাবুর প্রেমে পাগল, তিরিশের যুবক নীরার কথাভেবে আঙুল কামড়ায়, আবার জীবনের শেষের দিনগুলো আশির বৃদ্ধ কাঁদে পূর্ব পশ্চিমের প্রতাপের কথা ভেবে।
কোনও বিখ্যাত মানুষ মারা গেলেই আমরা অনেকেই সেই একই শব্দ ব্যবহার করি। এই যেমন অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল, ওনার মৃত্যুতে একটা বড় শূন্যতা তৈরি হল এই সব আর কি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুটাকে শুধু ওভাবে ব্যাখা করা যাবে না। বাকিদের চেয়ে তাঁর লেখা অনেকটা আলাদা ছিল। চিরচারিত ছকের বাইরে তাঁর লেখা তৈরি করেছিল আলাদা ঘরানা। সেই মানুষটার মৃত্যুতে অনেক টুকরো টুকরো ছবিগুলোও আলাদা হয়ে থাকল। সেই ছবিগুলোই প্রমাণ হয়ে থাকল নীললোহিতের শরীরটা আর আমাদের সঙ্গে থাকবে না ঠিকই কিন্তু ওনার চিন্তাভাবনা-লেখা আমাদের জীবনের অনেক কষ্টের মধ্যেও সুখের ঠিকানার খোঁজ দেবে।
নিজে কিছু ছেঁড়া ছবিকে জোড়া লাগিয়ে আমজনতার কাছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাঙালি হৃদয়ে কোন জায়গায় ছিলেন তা বোঝানোর একটা চেষ্টা করলাম।
ফোনের কান্না-- নবমীর সকালে খুব তাড়াতাড়ি বেজে উঠেছিল ফোনটা। ঘুম চোখে উঠেই ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে ধরা গলায় বলতে শুনলাম, শুনলি খবরটা। এরপর তার গলায় শুধু আবেগ আর কান্না। অন্যপ্রান্ত থেকে ফোনের গলাটা আমার দূর সম্পর্কের এক দিদির। অনেক বছর আগে সাহেবকে বিয়ে করে দিদি এখন লন্ডনের স্থায়ী বাসিন্দা। শেষবার যখন কলকাতায় এসেছিল দেখেই বুঝিছিলাম দিদি এখন খাঁটি মেমসাহেব। আদপ কায়দা, রুচি, চিন্তা, মতামত সব কিছুতেই দিদিকে রানী এলিজাবেথের দেশ ঘিরে রয়েছে। সেই দিদিই বিলেতের প্লেনে ওঠার আগে আবদার করে বসল, ভাই একটা বই দিতে পারিস যেটা পড়লে বিদেশের শতব্যস্ততার মাঝেও শান্তি দেবে। আমি নিজেই দিদিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা বই দিয়েছিলাম। এরপর মাঝে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা বছর। পরে জানতে পেরেছিলাম লন্ডন থেকে প্রায় একশো দশ কিলোমিটার দূরের এক নামকরা লাইব্রেরিতে দিদির উদ্যোগেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই রাখা শুরু হয়েছিল। আস্তে আস্তে তাঁর ভক্ত সংখ্যা বাড়তে বাড়তে আলাদা একটা ব্লক তৈরি হয়েছে। সেই লাইব্রেরিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর শোকসভা হয়, ছবিতে মালা টাঙানো হয়। সবচেয়ে মজার কথা পুরো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন স্থানীয় লোকেরাই। যাদের জন্য দিদি তাঁর এক বন্ধুর সাহায্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দশটা বই ইংরেজিতে তর্জমা করেছিল।
সেই মেয়েটা আর পূর্ব পশ্চিম-- ঢাকা থেকে বেশ অসুস্থ শরীর নিয়ে মেয়েটা এসেছিল আরও কিছুটা দিন বাঁচতে এসেছিল কলকাতায়। দক্ষিণ কলকাতার এক নামকরা নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিল। ডাক্তাররা বলেই দিয়েছিল বড়জোড় আর দিন কুড়ি বাঁচতে পারে সে। বাড়ির লোকের মুখে সেই কথা শুনে মেয়েটা হেসে উঠেছিল। সবার সঙ্গে নার্সিংহোমের বিখ্যাত ডাক্তারও তখন অবাক, মৃত্যু এত কাছে জেনেও কি করে হাসতে পারল! মেয়েটা তখন বলেছিল, অনেক আগে থেকে জানতাম আমি আবার বেশিদিন বাঁচতে পারব না। কলকাতায় আসার আগে শুধু একটাই দুয়া করেছিলাম আল্লা আমায় দয়া করে একটু সময় দাও যাতে আমার যে বইটা পড়ছি সেটা পুরোটা পড়ে ফেলতে পারি।" কথাটা শুনে নামজাদা ডাক্তারের চোখেও তখন জল। প্রশ্ন করলেন বইটার নাম কি। পৃথিবীর ক্ষণিকের বাসিন্দার মুখ থেকে উত্তর এল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব পশ্চিম। ডাক্তারের প্রশ্ন বইটা কত পাতা পড়া হয়েছে তোমার। উত্তর এল ৫২ পাতা। হিসাব করে দেখা গেল দিনে দু ঘন্টা করে বইটা পড়লে পুরো বইটা পড়া শেষ করতে পারবে সে। ডাক্তারের বিশেষ অনুরোধে তার কেবিনে দেওয়া হল বিশেষ আলো যাতে তার বই পড়তে কোন অসুবিধা না হয়, আবার তার কোনও অসুবিধাও না হয়। দিন যত এগোতে লাগল ততই তার শরীর দুর্বল হয়ে যেতে পরল। প্রথম কটা দিন দিনে অসুস্থ শরীর নিয়ে এক ঘন্টা করে সে পড়ল, কিন্তু দিন যত এগোল ততই সময় কমতে থাকল। শেষের দিন সে মাত্র ১০ মিনিট পড়তে পারল। মরে যাওয়ার আগে আব্বুর হাত ধরে বলল, বইটা পুরোটা পড়া হল না আব্বু তুমি এই বইটা আমার কবরের ওপর রেখে দিয়। পূর্ব পশ্চিমের শেষের চার পাতা পড়া হয়নি তার। দক্ষিণ কলকাতার এক গোরস্থানে তার কবরের ওপর রেখে দেওয়া হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব পশ্চিম।
(ঘটনাটা কলকাতার এক নামী ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে)
আমার লাইব্রেরিয়ান-- আমার পাড়ার লাইব্রেরিয়ান মানুষটি বড়ই মেজাজি মানুষ। সব কিছুতেই ওনার রাগরাগভাব, সব কথাতেই ওনার একটু হিটলারি মনোভাব। তখন সবে আমি লাইব্রেরিতে যেতে শিখেছি। লাইব্রেরিয়ানকে বললাম, "দাদা একটা ভাল বই দেবেন।" রাগ মেশানো গলায় বললেন, আলাদা করে বই ভাল- খারাপ হয় না। আগে বল তুমি কেমন ধরনের বই পড়বে? মাথা নেড়ে বললাম, দারুণ কিছু একটা। এবার সেই হিটলারের মত মানুষটা হেসে উঠে বললেন, জানো এই চেয়ারটায় বসে অনেকগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু একবারও কাজটা বোরিং মনে হয়নি। কেন জানো । উত্তরটা মুখে না দিয়ে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই হাতে ধরিয়ে দিলেন। ব্যস, সেই থেকে আমার সাহিত্যের সুনীল জগতে পা। ওই বদরাগি মানুষটাকে ধন্যবাদ।
পিস হেভেনে--বয়সের ভারে ভদ্রমহিলা এখন ঠিকমত হাঁটতে পারেন না। প্রায় ৮৫ ঊর্ধ্ব সেই বয়স্কা মহিলা নবমীর দুপুরে সব কিছু ছেড়েছুড়ে হাজির হয়েছিলেন পিস হেভেনে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। অনেক কষ্টে যখন মরদেহের কাছে এলেন তখন তাঁর চোখে জল। পিস হেভেন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ওনাকে প্রশ্ন করলাম, আপনি তো এতগুলো বছরে এত মৃত্যু দেখেছেন, এখনও আপনাকে মৃত্যু ছুঁয়ে যায়! বললেন, "কি জানো বাবা কারো কারো মৃত্যু শোকের চরমে নিয়ে যায়, কারো মৃত্যু আবার জীবনকে শূন্য করে দেয়। কিন্তু এই মৃত্যুটা আমায় জীবনকে নতুন করে ভাবতে শেখায়।"
আর সবশেষে আমি-- যে এই কপিটা লিখতে লিখতে চোখের কনে জল মুছতে ব্যস্ত।
তাই বললাম কাকাবাবু আপনি শুধু জিতে গেলেন না, জিতিয়ে গেলেন।
পার্থ প্রতিম চন্দ্র