মাউরিদের মাঝে দমদার আমের!

Updated By: Jan 7, 2016, 06:59 PM IST
মাউরিদের মাঝে দমদার আমের!

স্বরূপ দত্ত

মাউরি শব্দের অর্থ খুবই সাধারণ। একদম ছাপোষা। আলাদা কোনও ব্যাপারই নেই। কিন্তু, কথায় আছে না, সাধারণের মধ্যেই থাকে অসাধারণ! এবারও সেটাই ঘটতে চলেছে। বুঝতে পারলেন না কেন? এই মাওরি আসলে একটা উপজাতি। এই জাতির মানুষেরা ১২৫০ থেকে ১৩০০ সাল নাগাদ গিয়ে পা দিয়েছিল নিউজিল্যান্ডে। তারপর সেখানেই বসতি স্থাপন। আর ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে ছবির মতো এক আধুনিক শহর। অকল্যান্ড। যা মাউরিদের হাতে করে বানানো।

ভাবছেন, হঠাত্‍ করে অকল্যান্ডের কথাই বা বলছি কেন আর মাউরিদের কথাই বা বলা হচ্ছে কেন? খানিকটা আবেগ থেকে। কারণ, এই অকল্যান্ডে সাধারণের বসতিতেই ক্রিকেট দুনিয়ার হালের এক অসাধারণ নাটক মঞ্চস্থ হতে চলেছে। প্রেক্ষাগৃহ- ইডেন পার্ক। নাটকে কুশীলব অন্তত ২২ জন। কিন্তু মূল আকর্ষণই বলুন বা তারকা কিংবা হিরো অথবা তাকিয়ে থাকার কারণ, একজনই।
কে সে? এককথায় অসাধারণ। ২৩ বছরের ওই মানুষটার দিকেই তাকিয়ে রয়েছি। নাম - মহম্মদ আমের।

পাকিস্তান ক্রিকেটে অনেক অনেক প্রতিভা এসেছে গত এক শতকে। কিন্তু প্রতিভাই বলুন অথবা সাধারণ, কাউকে এমন চরম পরীক্ষা দিতে হয়নি ক্রিকেটের ২২ গজে অথবা বাস্তব জীবনের বোলিং মেশিনের সামনে। যার সামনে বসতে হচ্ছে মহম্মদ আমেরকে। কী ঘটেছিল। সবার জানা। আজকের বিষয়ে তবু ঢুকে পড়ার আগে, একটু 'আগে কী ঘটেছিল' অথবা 'ফ্ল্যাশব্যাক'। সেই দৃশ্য মনে পড়ে? ভুলেই বা যাবেন কোথায়! বল করছেন আমের। সেই সাদা রুমাল। দেখিয়ে দেখিয়ে প্রতিশ্রুতি মতো নো বল। টেলিভিশন স্ক্রিনের সেই সবুজ মাঠে সাদা পোশাকের লাইভ খেলায় কীভাবে যেন গোল করে লাল কালির দাগটা পড়ে গেল। সেই থেকে আমের মানে খারাপ। আমের মানে চোর। আমের মানে ছিঃ। আমের মানে কাফের। আমের মানে বিভীষণ। আমের মানে অসহ্য। আর আমের মানে বড্ড গরীব। না হলে কটা টাকার লোভে কেউ দেশের জার্সিতে খেলার সময় ওভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে বলে বলে নো বল করে ওএলএক্সের থেকেও দ্রুত গতিতে ম্যাচ, দেশকে আর নিজেকে বেচে দিতে পারে!
 
চোর ধরা পড়ারই ছিল। আমেরও ধরা পড়েছিলেন। তাঁর শাগরেদ সলমান বাট আর আসিফ ফেঁসে গেলেন। বয়সে বড়। নাটের গুরু। আমের নাবালক। জীবনের শুরু। তাই দোষী সেও। কিন্তু শাস্তি কমও। একদম ছাড়া পাননি আমের। জেল খেটেছেন। নাবালকের শাস্তির আইন অনুযায়ী যতদিন, ততদিনই। এই অবধি গল্পটা জানা। আমার। আপনার। সকলের। এরপর শুরু সিক্যুয়েল। বাহুবলী কিনা জানা নেই। তবে, মনে তো দম রয়েছেই। আমের ক্রিকেটকে ছাড়লেন না। খেলতে এলেন। পিসিবি আটকালো না। খেলতে দিল। এবং অবশেষে আমের নিউজিল্যান্ড সফরের তিনটে টি২০ ম্যাচ এবং তিনটে একদিনের ম্যাচে দলে সুযোগ পেলেন। আর পেয়ে গেলেন ভিসাও।
 
এবার যেগুলো বলার। গত কদিন ধরে সমানে সব খবর রাখছিলাম আমেরের। জানার কৌতুহলে। খবরের ধরনে। আর খানিকটা আসাধারণের মোহে। আর মাঝের কটা দিনে কেমন যেন হয়ে গেলাম, আমেরের আমিরি শুভাকাঙ্খী। আমেরের জন্য মন কথা বলা শুরু করল। শুরুর দিকগুলো মস্তিষ্ক ব্যাগড়া দিচ্ছিল। ও ভালো নয়। চোর। কাপুরুষ। দেশদ্রোহী। ক্রিকেটের ব্যাট-বল ধরার কোনও অধিকার তাঁর আর নেই। মন আরও বেশি স্ট্রং যুক্তি দেওয়া শুরু করল। কারণ, আমের যত সমাজচ্যুত হচ্ছিল, মন তত ওকে ভালোবেসে ফেলছিল। একা মানুষের মনের পাশে একটু দাঁড়াবো না? মন আবার ওয়াঘার সীমান্তের এ পাশে আটকে থাকে নাকি!

পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড ভালো। তাঁরা সুযোগ দিয়েছে আমেরকে একটা। এই কৃতজ্ঞতা কোনওদিন ভোলার নয়। এই কৃতজ্ঞতার কোনও দাম নেই। একবার ঠকলে, সামনের মানুষকে আর একটা সুযোগ দেওয়ার নিয়মটাই থাক পৃথিবীতে। সেবার আবার ঠকালে, ফের সুযোগ দাও। এই বিশ্বাসটাই থাকুক পৃথিবীতে। অন্তত ক্রিকেট মাঠটায় থাক। পিসিবি পথ দেখালো। অবশ্য ওটা পিসিবির পার্ট। আর আমের কী করলেন? জেল থেকে ফিরে এলেন। নির্বাসন কাটিয়ে এলেন। মাঠে ফিরলেন। আর প্রথম ওভারেই উইকেট নিলেন ২০১৫-র ১৩ মার্চ। নিজেকে নিংড়ে দিলে ১৩-তেও বৃহস্পতি তুঙ্গে তোলা যায়। সেই শুরু। ঘরোয়া ক্রিকেট একের পর এক ম্যাচ খেলতে নেমেছেন। প্রায় সব ম্যাচে উইকেট পেয়েছেন। পিসিবিও বা কতদিন মুখ ফিরিয়ে থাকত!

পিসিবি সুযোগ দিল। কিন্তু সমাজে কিছু মানুষ থাকেই, যাঁদের কোনওদিন স্বাদ, তেষ্টা, ক্ষুধা, ইচ্ছে, কিচ্ছু মেটে না। এরা মর্দের হাতে লিখে দিতে চায় সারা জীবনের জন্য 'মেরা বাপ চোর হ্যায়'। পরে কখনও দেখা হলে, এরা দূর থেকে চেঁচিয়ে বলেও, ওই দ্যাখো চোরের ছেলে চোর যাচ্ছে। এরা থামতে জানে না, অন্যকে কষ্ট দিতে। এরা বিশ্বের সমস্ত জঙ্গি সংগঠনের থেকে নিষ্ঠুর। এরা অস্ত্র হাতে তোলে না। মাথা কেটে নেয় না। কিন্তু পাশের মানুষের মনটায় নিজেদের ধারালো তরোয়ালটা বারবার করে চালিয়ে দেয়। এরা সে রক্তে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। খানিকের বিশ্রাম। পরে ফের অন্য কসাইকে দিয়ে সমাজের মধ্যে থাকা মানুষটার বুকে আবারও ছুরি চালায়। এরা জানে না, শাস্তি এভাবে দিয়ে যাচ্ছো যে, এ পৃথিবীর সব একদিন থামে। তোমাদের শাস্তি থামে না!
এত কথা বলা ওই আজহার আলি এবং মহম্মদ হাফিজদের জন্য। শুধু আমের লাহোরে প্র্যাকটিসে যোগ দিয়েছেন। কেন এমন? তাই প্র্যাকটিসে আসাই বন্ধ করে দিলেন পাক ক্যাপ্টেন আজাহার আলি থেকে সিনিয়র ক্রিকেটার মহম্মদ হাফিজরা। পিসিবি একটু কড়কে দিতেই সব সুড়সুড় করে ফের দলে যোগ দিলেন।
 
আগামী ১৫ জানুয়ারি, সবুজ জার্সিতে কালো নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলতে নামবেন আমের। মাউরিদের হাতে গড়া সাধারণ অকল্যান্ডে অসাধারণ হয়ে। প্রশ্ন জাগছে আপনার? কেন এত তোল্লাই দিচ্ছি আমেরকে? কেন এত সহানুভূতি পাবে আমের? কারণ, ওর ২৩-এর দম। কারণ, আমের হারতে জানে না। কারণ, আমের বলতে পারে, 'আমি এখন একেবারে পাল্টে যাওয়া একটা মানুষ। আমি এবার শক্তি, মন আর মস্তিষ্কর সঙ্গে আত্মা দিয়েও খেলব। আমি আবার জিতব। আবার দেশকে জেতাবো।' পেলেন না অনুশোচনা কথাগুলোয়? ২৩ বছরের মানুষ কত বড় হয়? সেই ২৩-এও শাস্তি পেতে পেতে মানুষটা মনে হচ্ছে সত্যিই পরিণত হয়ে গেল। এই নিউজিল্যান্ড সফরে সাদা বল হাতে সবুজ জার্সি গায়ে ওয়াহাব রিয়াজের সঙ্গী বোলার হবেন আমের?

যদি সত্যিই ১৪ জানুয়ারির রাতে টিম মিটিংয়ের শেষে আজাহার আলি এসে বলেন, 'আমের কাল তুই ফার্স্ট ইলেভেনে'! কীভাবে রাতটা কাটাবেন আমের? কী চলবে মনের ভিতরে তাঁর গোটা রাতটা জুড়ে? সেই রাতটার পরের ভোর হতে ঠিক কত সময় নেবে? কটা টাকা আর একটা রুমাল যে মানুষটাকে মেরে ফেলেছে পাপের মনে মনে। সারা রাত জেগে অথবা দুটো ঘুমের
ওষুধ খেয়ে সকালে উঠে যখন ফের পাক জার্সিটা গায়ে চড়িয়ে মাঠে নামবেন, বলটা হাতে নেবেন, কী চলবে আমেরের মনে! বল হাতে দৌড়নোর সময়, ডেলিভারিটা করবার মুহূর্তে আম্পায়ার যদি পিছন থেকে চেঁচিয়ে ওঠেন, 'নো'! কটা বাজ একসঙ্গে পড়বে আমেরের বুকে! একটা উঁচু ক্যাচের পিছনে দৌড়নোর সময় মনের ভিতরে কটা হাইড্রোজেন বোমা ফাটবে ছেলেটার! আর যদি ৩ বলে ২ রান করতে হবে, এমন সময় আউট হয়ে যান আমের, কী হবে ওরঁ বুকের মধ্যে! কটা দাবানল জ্বলবে!

গোটা পৃথিবী চেঁচিয়ে উঠবে নানা ভাষায়। মোদ্দা কথায় যার মানে, 'চোর শালা'! অকল্যান্ড থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে আমেরের পরিবারের নিরাপত্তা কে নেবে তখন! ওঁর বাড়িটা আস্ত থাকবে তো! ভাবলেই শিউরে উঠছি লাহোর থেকে কত দূরের কলকাতায় বসে! এসব কি আর আমেরের মনেও রোজ রাতে-দিনে চলে না! সে তো কাউকে মন খুলে বলেও না। পালাননি আমের। বুকটা চিতিয়ে ওই ২৩ বছরের ছেলেটা প্রমাণ করতে এসেছেন যে, 'হ্যাঁ, আমি চুরি করেছি। কিন্তু আমি চোর, এটা চিরন্তন সত্য নয়! একটা সুযোগ তোমরা দিয়েছো! একটা প্রতিদান আমারও দেওয়ার।' সত্যি সাদা পোশাকের ক্রিকেটটায় যেন নাবালক আমেরের ছোঁয়া লেগে আজ সাবালক হল। পৌরুষ এল। এটা আর কমলালেবুর খোসা ছাড়ানো, সোয়েটার বোনার মুহূর্তে দেখার সময় নয়। ২০১৬-তে মানুষ জীবন বাজি রেখে ক্রিকেট খেলে। শুধু একটাবার চেঁচিয়ে বলার জন্য-'আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি। কিন্তু আমি চোর নই। আমারও বাঁচতে ইচ্ছে করে। আমিও পুরুষের মতো বাঁচবো।'

যে ভালো আজ আমেরকে বাসছি, তাতে স্থির বিশ্বাস, জিতবেই আমের। ঠিক জিতবে। নাহলে, আমার ক্রিকেট ভালোবাসাটাই ভুল প্রমাণ হয়ে যাবে। কারণ, আমের ছাড়া আজ পর্যন্ত আমি এমন কোনও বোলারকে দেখিনি, যিনি টেস্ট, একদিনের ম্যাচ, টি-২০ যেখানে যখন খেলেছেন, ব্যাট হাতে সর্বোচ্চ রানের দিনে, কোনও 'মাইকা লাল' তাঁকে আউট করতে পারেননি। হ্যাঁ, আমেরের টেস্টে সর্বোচ্চ রান ৩০ অপরাজিত। একদিনের ম্যাচে সর্বোচ্চ রান ৭৩ অপরাজিত। আর টি-২০-তেও সর্বোচ্চ রান ২১ এবং সেটাও অপরাজিত! আমের। সঙ্গে আছি। জানি তুমি অপরাজিতই থাকবে। প্রমাণ করে দেবে, একটা চুরি, কাউকে চিরকালের চোর বানায় না। মাউরিদের মাঝে তুমি সত্যিই অসাধারণ!

 

 

.