হেঁইয়ো মা দুগ্গা!
খুশির শিউলিফুল ভোর। দেরি করে মা আসছেন বলেই মেঘের ছমছমে ভাব উধাও। মহালয়া আসছে। পুজো মানে অনেক কিছু। সঙ্গে বাঙালির বাংলা পরীক্ষা শুরু। বানানে কেমন পাণিনি, সেটা আকাশ-বাতাসে দুলতে থাকা হোর্ডিং দেখলেই হৃদয়ঙ্গম হয়।
খুশির শিউলিফুল ভোর। দেরি করে মা আসছেন বলেই মেঘের ছমছমে ভাব উধাও। মহালয়া আসছে। পুজো মানে অনেক কিছু। সঙ্গে বাঙালির বাংলা পরীক্ষা শুরু। বানানে কেমন পাণিনি, সেটা আকাশ-বাতাসে দুলতে থাকা হোর্ডিং দেখলেই হৃদয়ঙ্গম হয়। দুর্গা নামের বদলে দেদার দূর্গা চলে, কেউ কিছু মনে করে না। পূজার বদলে পুজা, পুজোর বদলে পূজো, দুর্গাপুজা, দূর্গাপুজা.. কত যে পারমুটেশন-কম্বিনেশন! সত্যি, বাঙালি কি বিষম ভ্যারিয়েশন-ভক্ত..
আগে সরস্বতী পুজোর চাঁদা চাইবার আগে বানানটা জেনে যাওয়া দস্তুর ছিল। অনাদায়ে কানমলা খেতে হত কিনা। আজকাল ছাত্রদের আবার কান মলে দেওয়া নিষেধ। মাস্টারমশাইদের ঠ্যাঙানোটাই রীতি। তাই মার খাওয়ার ভয়ে বোধকরি ভুল বানানেও লাল ঢ্যারা দেন না স্যরেরা। অগত্যা... অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া উপায় দেখি না। বালোক সংঘ, জুবক শমিতি-রাও চলছে-চলবে রোয়াব নিয়ে দূর্গাপুজা ইত্যাদি করে চলেছেন। এই সেদিন এক টিভি চ্যানেলের অ্যাঙ্কর দিব্যি এক ঘণ্টা ধরে দুর্গোপুজো-দুর্গোপুজো করেই গেলেন, কেউ টুঁ শব্দটি করল না।
দেবী দুর্গতিনাশিনী এখন গ্লোবাল। আন্টার্কটিকা বাদ দিয়ে সব মহাদেশে ধুন্ধুমার পুজোপার্বণ হয়। বিলেত থেকে পিলপিল করে লোক আসে বলে টুরিজম বুস্ট হয়, তার ওপর থিমপুজোর সাড়ম্বর ষোড়শোপচারের মাঝখানে অমন দুয়েকটা ছোট্ট ভুল মা ক্ষমাঘেন্না করেই দেন বোধহয়। গত সাত দিন আমার চোখের পরিধির মধ্যে যতগুলো পুজোর ব্যানার দেখেছি, কেউ কারওর চেয়ে কম যায় না!
নিন্দে করব না। বাংলার বহর এবং কলেবর দেখলে অবশ্য বোঝা যায় বানানে ‘একটু’ কমা হলে কী হবে, বাঙালির দুর্গাপূজার বিজ্ঞাপনে ব্যঞ্জনায় শব্দঝংকারসৃষ্টির চেষ্টা দেখলে ডি. এল রায়ের আত্মাও প্রেত হয়ে নেমে আসবেন! জল বানানটাও যেন ‘জ্জ্বল’ হয়ে জ্বলে ওঠে বাঙালীর পুজো-কলমে! কথা কম বলে শুধু পোস্টার দেখে যাই-- মহাপুজায় মহাদুর্গ্গার মহাপ্যানডেলে মহানন্দে মহাসুখে আসুন। মাত্রিপুজোর আরাধনায় দলে দলে শামিল হোন। বালিগ়জ্ঞ সাব্বজনিন মহাদূর্গাপূজোর সারদিয় সুভেচ্চা। মহিশ্বশুরমরদীনী পালা এবার দেখুন একমাত্র কলাতলা শ্রাবন সংঘোয়। মহাসারদীয়ার প্রিতি ও শুভেচ্ছা গ্রহন করুন, আমাদের ক্যাকটাস-মন্ডোপ দর্শণ করুন, দেখে গায়ে কাঁটা দেবে)...আমরা প্রতিযোগীতায় বিশ্বাসী নই/ এবার পূজোয় নতূন চাই/ সিডির মম্ডোপ দেখুন ভাই। দাঁত বিজড়ে অক্ষয়কুমার বলছেন, সপোরিবারে ডলার আন্ডি পরে মন্ডপ পরিদর্শণ করুন। শরত্ তোমার ওরুন আলোর অঞ্জলি। এসএমএস-এ চন্ডিপাঠ। সন্ধীপূজোর মহাযঞ্জ। মা আসছেন @ মর্ত্য.কম...
আজ সকালে হোর্ডিংটা দেখে হেঁচকি উঠল। ‘দলে দলে প্যান্ডেলে আসুন/ মাতৃময়ী দুর্গামাতার রমণীয় রূপ রমণ করুন’...
এক মিনিট, রম্ ধাতু অর্থে ‘রতিক্রীড়া’, -ণ (স্ত্রী)। রমণ ক্রিয়াপদ। রতিরতরাগিণীরমণবসন্ত রাধা। (প্র: বঙ্গীয় শব্দকোষ, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পা)
এরপরও কী বলবেন আপনি ইংরেজিতে ভাল? আমি কিছু বলব না। বললে বলবে বলছে!
যাই হোক, বানানে আমার কী যায় আসে! এবার পুজোয় মুম্বইয়ে থাকব। সেলেব-পুজো কভার করতে। আমার ডালিমকুমার কলকাতায় থাকবে। মাঝে মাঝেই চোখ ভিজে যাচ্ছে। শিউলিফুল, আগমনী, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, থিমপুজো সব জল-রং হয়ে ধুয়ে যাচ্ছে। ডালিমকুমার আমার চেয়ে বেশি ফ্যাশন-কনশাস। আমার জন্য আগে থেকেই তিনটে হালফ্যাশনের সালওয়ার-সুট কিনে আলমারিতে গুছিয়ে রেখেছে। আজ সকালে দেখে ফেললাম।
ফ্যাশনের কথাই যখন উঠল, এবার পুজোয় যেমন-খুশি-সাজো ইন থিং। লালপেড়ে শাড়ির সঙ্গে ক্যাঁটক্যাঁটে কেডস বেশ চলছে। শ্রীমান পৃত্থীরাজরা কাঁখে করে বউকে তুলে নিয়ে স্টাইলবাজি করছেন। কেউ বা হাঁসজারুর মতো দিব্যি জেব্রাঘোড়া বানিয়ে ফেলছেন। যাকগে, সবাই জানি চাঁদার ইংরেজি সাবস্ক্রিপশন। পুজোর মরশুমে এক নতুন চাঁদা-তোলাবাজি শুরু হয়েছে। মাঝেমাঝেই ল্যান্ডলাইনটা ট্রিং-ট্রিং বেজে ওঠে। ম্যা়ডাম আপনি কি এ--র সাবস্ক্রিপশন ফর্ম ফিল-আপ করেছেন?
না।
কেন ম্যাম?
কেন, করাটা কম্পালসারি বুঝি?
না না ম্যাম, আপনার বাংলা আর ইংরিজি কাগজের সঙ্গে কম্বো প্যাকেজে এক টাকারও কমে দিচ্ছি, এর পর আর পাবেন না...
থ্যাঙ্কস, আমি এ---টা নেব না, এ---টা নেব ঠিক করেছি।
ওকে আচ্ছা ঠিক আছে..
আবার ট্রিং ট্রিং।
ম্যাডাম, আপনি কি কাগজে গাঁজাখুরি পড়তে পড়তে বিরক্ত? ট্যাবলয়েড ছেড়ে নতুন বাংলা কাগজ সাবস্ক্রাইব করুন। এক টাকারও...
নামদুটো ইন্টারচেঞ্জ বলি, আমি এ---টা নয়, এ---টা নেব ঠিক করেছি।
আসল কথা, ডালিমকুমার কিছুতেই বাড়িতে উঠতে দেবে না ওই কাগজ। নব্বই টাকাও ইয়ার্কি না। টাকা আর বিদ্যা (বালান নয়) এক নয়। দান করলে বাড়ে না। কাজেই দাম্পত্যকলহ না বাড়িয়ে বেলাবেলি হকারের কাছ থেকেই দুটাকা দিয়ে কিনে ফেললাম। ওঃ মা, ট্যাবলয়েড না বড় ভাইয়ের ছোট ভাই? চমক-ঠমক কই? কোথায় ভেবেছিলাম জন্মেই এমন ট্যাঁ করে চিত্কার দেবে যে, সব বড়রা চুপ করে যাবে। কোথায় কী! গচ্ছা বলে গচ্ছা! অবশ্য আগেই বিজ্ঞাপনে ডিফেন্স খেলেছে। বলেই দিয়েছে ওরা ওদের মতো। কী করে পারেন মশায়, একই খবর, একই ভাষা, একই জ্ঞান একটাকারও কমে অফার করতে? কয়েন দিয়েও আজকাল ব্লেড তৈরি হচ্ছে। মাগনা নয়। অবেলায় ভাত খেয়ে বিশ্রী বদহজম হয়ে গেল। ঠোঙাওয়ালার কাছে রিটার্ন ভ্যালু নেওয়ার এই তো সময়! কানাঘুষো শুনছি, মহালয়ার আগেই নাকি দুঃসময় দূর হয়ে যাবে। সময়ের স-কে ঘিরে লাল সূর্য দেখা যাচ্ছে। বলছে তো ওদেরটা নাকি আরও বড়!
মহালয়ায় মা দুর্গার চোখদুটি আঁকা হলেই হাড্ডাহাড্ডি রগড়টা সচক্ষে দেখতে পাবেন!
ফুলকলি