বছর কুড়ি পরে
আমার রবীন্দ্রনাথ আছেন, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল আছেন, হিমাংশু দত্ত, মোহিনী চৌধুরী আছেন, আছে বাউল, ফকির, দরবেশি, গণগীত। আছেন ধনঞ্জয়, সতীনাথ, জটিলেশ্বর, পান্নালাল, সলিল চৌধুরী। আছেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়...। তবু সুমন। এক প্রখর বাস্তব।
যে তুমি চিত্রিত আমি তোমাকেই বলি। আলো ক্রমে আসে। কেন না অন্ধকার আসে। যে বাক্য দ্যুতিময়। যে বাক্য ফকিরের তাকে আমি জনমে জড়াই। তুমি হে ফকির, এদেশি রতিরঙ্গে তোমাকেই অগ্রপথিক মনে করি। মনে করি রতিরঙ্গ জীবনতামাসা। আমার বুকের বর্ণ রৌদ্ররেখাময়। আমার লহুর বর্ণ অশনিদীক্ষিত। আমার বেদনা আজ নগরের আলোবর্তিকায়। আমার প্রশ্বাস আজ সামাজিক বিভ্রমে। আমি তোমাকে চাই। যে-তুমি স্মৃতি, যে-তুমি করুণাঘন ইতিহাস, পত্রমর্মর। এসো বাঁচি। বাক্যে বাঁচি, শব্দে। সুরে বাঁচি, একা মানুষের তোমাকেই বলি। তুমি বাঁশিওয়ালা, হ্যামলিনের।
সে এক রূপকথার দিন ছিল। বিশ বছর আগের এক রাঙা বিকেল। একাডেমি অফ ফাইন আর্টস। অলীকের প্রদর্শনীকক্ষ, অলীকপ্রদর্শকাণ্ড। প্রথম শোনা। নেশাসম্মোহন। সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে....। সেই শুরু। শুরু গানের গাঁয়ে আমার বসত। সুমনের গানের। আমার রবীন্দ্রনাথ আছেন, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল আছেন, হিমাংশু দত্ত, মোহিনী চৌধুরী আছেন, আছে বাউল, ফকির, দরবেশি, গণগীত। আছেন ধনঞ্জয়, সতীনাথ, জটিলেশ্বর, পান্নালাল, সলিল চৌধুরী। আছেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়...। তবু সুমন। এক প্রখর বাস্তব। এক প্রবল জলাশয়। এত তৃষ্ণা যে আমারই তা কি আমিই জানতাম! এত প্রেম, এত বিদ্রুপ, এত গরল, এত স্বপ্নভঙ্গ যে আমার মধ্যে প্রতিনিয়ত তা কোনও সুর। সুরবাক্য, সুরধ্বনি কি, আমাকে এমনভাবে চিহ্নিত করেছিল! প্রোথিত করেছিল আমার শিকড় এই নগরে! আমার চারিধারে ঝুলিয়ে দিয়েছিল বিভিন্ন গড়নের মুকুর! নগরমুকুর! সুমনের গান নিরুপায়ভাবে আমার ব্যক্তিগত হয়ে উঠল। দশ ফুট বাই দশফুট ঘরের ভেতরের আমার একাকীত্বকে স্পর্শ করল এক আশ্চর্য সঙ্গী। মনে হল, আমি যেন প্রেমিক ছিলাম।
ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট। গান গাইছিলেন সুমন। ১, ২, ৩, ৪, ৫ সংখ্যক গানের একটি লাইন-তারপর তোর বাপের দেওয়া খাটের ওপর চিত্ হয়ে তুই উগরে দিলি সতীত্ব তোর....। বসে থাকতে পারলাম না। হল থেকে রাস্তায়, আমাকে কে যেন চাবকেছে! আমার দেহে জ্বালা। আমার মনে জ্বালা, সবুজ সূর্যাই, আমি তেপান্তরে যাব। আমার নিভৃত কশাঘাতের নাম সুমনের গান। সুমনের গান আমাকে ক্ষতবিক্ষত করে, রক্তাক্ত করে। আমার চারিধারে নগরমুকুরে জেগে ওঠে নানাবর্ণের বিস্ময় ও জিজ্ঞাসাচিহ্ন। আমি আরও রক্তাক্ত হতে চাই, আরও তমসালিপ্ত, আরও আনন্দিত। হ্যাঁ, আমি তোমাকে চাই প্রজন্মের এক নিরুপায় নাগরিক।
রাহুল পুরকায়স্থ